না, কোথায় যাবো? তুমি অহেতুক চিন্তা করো না–আমি তোমাকে ত্যাগ করে কোথাও যাবো না। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বসন্তদাস।
না, আমার মন বলছে, তুমি চলে যাবে, বলল, তুমি কী ভাবছো?
বসন্তদাস স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে দেখে বারেক। ভাবে, সরলা এই গৃহবধূর কাছে সে নিজ চিন্তা–ভাবনার কথা বলবে কি বলবে না। তারপর সে বলে, আমি কি চিন্তা করি শুনবে? শোনো তাহলে, আমি তোমার আমার মতো মানুষের কথা ভাবি। দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে–এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতোদিন এভাবে চলবে? গ্রামপতি, সামন্তপতিরা যথেচ্ছ অত্যাচার করে যাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না–ওদিকে আবার যবনরা ধেয়ে আসছে, তাদের তরবারির নীচে কত মানুষের শির ছিন্ন। হবে তাও কেউ বলতে পারে না। আমি চিন্তা করি এই অবস্থার পরিবর্তনের কথা।
কিন্তু তুমি কী করবে, যুদ্ধ করবে? মায়াবতীর স্বরে আতঙ্ক ফোটে। বলে, তুমি একাকী কেমন করে যুদ্ধ করবে–যুদ্ধ করলে তো মানুষের মৃত্যু হয়।
মায়াবতী স্বামীকে দুবাহুতে বেষ্টন করে ধরে।
বসন্তদাস স্ত্রীর কথায় হাসে। বলে, না আমি কেন যুদ্ধ করবো, যারা যুদ্ধ করতে চায়, আমি তাদের বলবো যে যুদ্ধ করো না, যুদ্ধ করলে মানুষ ধ্বংস হয়।
না, সে কথা বলার তুমি কে? এ সকল কথা ভয়ানক–তুমি সামন্তপতিদের সঙ্গে কথা বলতে যাবে না–তাদের ভারী ক্রোধ–দেখোনি, তুমি ভিক্ষুদের সঙ্গে মিত্রতা করেছিলে বলে কতো কাণ্ড ঘটলো?
বসন্তদাস বিমূঢ় বোধ করে। কোন্ ভাষায় সে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বোঝাবে। তথাপি বলে, এ একজনের ব্যাপার নয় মায়া–এ হচ্ছে সকল মানুষের ব্যাপার। আমি যদি ঐ সকল কথা নাও বলি, তাহলেও আমরা রক্ষা পাবো না। যদি বিলম্ব হয়ে যায় যুদ্ধকারীদের বোঝানো না যায়–তাহলে সর্বত্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাবে। কেউ রক্ষা পাবে
না, আমরাও না। এ অবস্থার কিছু একটা করা প্রয়োজন।
মায়াবতীর কিছুই বোধগম্য হয় না। তার এক কথা, তুমি ঐ সকল ভয়ঙ্কর ব্যাপারে যাবে না। গেলে আমি আত্মঘাতিনী হবো।
কিন্তু এভাবে কতদিন? একেবারে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা আর চরম সর্বনাশের জন্য অপেক্ষা করা? তার মনে হয়, এভাবে দিনযাপন একেবারেই অর্থহীন। সমূহ সর্বনাশ আসন্ন অথচ সে কিছুই করছে না, কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই তার। ধিক বসন্তদাস, ধিক তোমার এই জীবনে! সে একাকী কেবলি নিজেকে ধিক্কার দেয়। ভিক্ষু মিত্রানন্দ জীবন বিপন্ন করে কোন স্থান থেকে কোন স্থানে চলে যাচ্ছে–বিভাবতী কৃষ্ণা শুক্লার মতো রমণীরা আত্মাহুতি দিচ্ছে আর তুমি গৃহসুখ উপভোগ করছো? অল্প কদিনের মধ্যেই সে ক্লান্ত হয়ে উঠলো। এবং একদা হঠাৎ জানালো, আমি নিজ গৃহে যাবো, পিতা–মাতাকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়েছে।
এই কথার পর কারও কিছু বলার থাকে না। যোগমায়া মৃদু আপত্তি করেন, কিন্তু সেই আপত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অবশেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়াবতী স্বামীকে বিদায় দেয়। বিদায়কালে বলে, শীঘ্র ফিরে এসো, বিলম্ব হলে আর আমাকে জীবিত দেখবে না।
স্বগৃহে যাওয়া তার প্রয়োজন বটে, কিন্তু সে যাত্রা করে বিপরীত দিকে, পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে।
সেখানে গিয়ে দেখে, মিত্রান ফিরে এসেছে। এবং সে অত্যধিক ব্যস্ত। কেন ব্যস্ত, কিসে ব্যস্ত, কিছুই বলে না সে। নগরপ্রান্তে প্রকাণ্ড একটি বিহার–যেমন প্রাচীন, তেমনই তার ভগ্নদশা। সে অবাকই হলো এক প্রকার। এতে ভিক্ষু একত্রে সে জীবনে দেখেনি। বাহির থেকে দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এতো অধিক সংখ্যক ভিক্ষু এ স্থানে বসবাস করে।
মিত্রানন্দ অবশ্য জানিয়েছে যে ভিক্ষুদের সকলেই এই স্থানের নয়। বহুসংখ্যক ভিক্ষু বহিরাগত। কিন্তু তথাপি এতো অধিকসংখ্যক ভিক্ষুর একত্র সমাবেশ তার কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়েছে। মিত্রানন্দকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করলে বলে, অপেক্ষা করো, অচিরেই সমস্ত কিছু জানতে পারবে। সম্ভবত আমরা শীঘ্রই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছি।
আবার সেই অপেক্ষার কথা।
অবশেষে দেখলো, ঐটিই হলো মূল কথা–অপেক্ষা করা হবে, কি হবে না। তরুণ ভিক্ষু নিরঞ্জন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ঐ অপেক্ষার কথা শুনে।
বসন্তদাস লক্ষ্য করে দেখলো, অত্যন্ত তেজস্বী এই তরুণ ভিক্ষুটি। লক্ষ্য করে দেখার আরও একটি কারণ ছিলো। ছায়াবতীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই নিরঞ্জন।
ভিক্ষুসভায় তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নিরঞ্জন। বলে, আর কতোকাল আমরা অপেক্ষা করবো, বলুন? বহুকাল অপেক্ষায় অতিবাহিত হয়েছে, আমাদের ধর্ম নিঃশেষ প্রায়, জ্ঞান আচ্ছন্ন, বুদ্ধি অবসাদগ্রস্ত–এরপরও কি অপেক্ষা করতে হবে? এ অপেক্ষার অপর নাম তাহলে মরণ। এভাবে আমরা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে চাই না। আপনারা মহাভিক্ষুদের নির্দেশ নিয়ে আসুন।
অপরাহ্নের রৌদ্র এসে পড়েছিলো তার মুখে–এবং ঐ রৌদ্রে তার কাষায় বস্ত্র, গৌরবোজ্জ্বল মুখ, মুণ্ডিত মস্তক–সমস্ত একত্রে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছিলো।
একজন বয়স্ক ভিক্ষু তাকে নিবৃত্ত করার জন্য বললেন, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, বলতে পারো, আমাদের ক্ষমতা কতোখানি? তোমার পরিকল্পনা কী, আমাদের কাছে বলবে?
নিরঞ্জনের ঐ কথায় যেন সম্বিত হয়, ঈষৎ লজ্জায় মাথা নত করে। তবে সে দমিত হয় না। বলে, মহাভিক্ষুরা সমবেত হয়ে বিচার করুন, এবং শীঘ সিদ্ধান্ত নিন, এইটিই আমাদের কথা।