দীনদাস সুনন্দপুরে এসে শুকদেবকে ঐ অপেক্ষা করার কথাই বলেন। জানান, ভ্রাতঃ, উপায় নেই এখন অপেক্ষা করা ব্যতীত, উজুবটে প্রত্যাগমন এখন অসম্ভব।
শুকদেব কিঞ্চিৎ সুস্থ এখন। তাঁর বিষণ্ণ নির্জীব ভাবটি আর নেই। যোগমায়ার মুখেও হাসি দেখা যায়–আর মায়াবতী হয়ে উঠেছে পূর্বের মতোই। এই পরিবর্তনের কারণ একটিই আর তা হলো বসন্তদাসের আগমন। বসন্তদাস সুনন্দপুরে আসে দীনদাসের আগমনের সপ্তাহকাল পূর্বে। তার আগমনে, বলাই বাহুল্য, নির্জীব এবং হতাশ এই উদ্বাস্তু পরিবারে স্বস্তি আনন্দ এবং উল্লাস একইসঙ্গে জেগে ওঠে। বসন্তদাস উজুবট ও নিকটবর্তী গ্রামগুলির অবস্থা জানিয়েছে শুকদেবকে। শুধু গ্রামের কথা নয়, রাজধানীর সংবাদও। যবনদের সংবাদ, ভিক্ষুদের সংবাদ, সমস্তই জানিয়েছে। এবং শেষ কথা বলেছে, আপাতত কিছুই করণীয় নেই, এ স্থানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সমস্ত কিছু শোনার পর শুকদেবের মনে হয়েছে ঐ একই কথা। এখন সত্যই কিছু করণীয় নেই–অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু যোগমায়ার কষ্ট হচ্ছে। দান ঋণ এবং স্বল্প সঞ্চয়ে তার সংসার আর কতোদিন চলে? প্রতিবেশীরা করুণা করে, নানান মন্তব্য করে একেকজন, তাতে তার অসহ্য বোধ হয়। নিজ গৃহে তাঁর কোনো অভাব ছিলো না–কিন্তু এখানে অভাব বোধ করছেন প্রতি পদে। তাঁর আশা হয়েছিলো, দীনদাস শুভ সংবাদ নিয়ে আসবেন এবং তারপরই তিনি স্বামী সংসার নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু এ কোন কথা শুনছেন? আরও নাকি অপেক্ষা করতে হবে? কতদিন? স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন। শুকদেব দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলেন, জানি না।
কিন্তু মায়াবতী ঐ কথা শুনবে না। অভিমানে ওষ্ঠ স্কুরিত হয়, চোখে অশ্রু উদ্বেল হতে দেখা যায়। আর বলে, না আমি আর একদণ্ডও থাকবে না এ স্থানে। স্বামীকে কাছে পেয়ে তার অভিমান হয়েছে আরও অধিক। বসন্তদাসের সঙ্গে সে কলহে প্রবৃত্ত হয়। বসন্তদাস স্ত্রীর অভিমান এবং ক্রোধের কারণ বোঝে, কিন্তু কোনো পথ যে সত্যই নেই, সে কথাটি সে স্ত্রীকে বোঝাতে পারে না।
অবকাশও স্বল্প। কারণ একটি কুটিরে বাস–কুটিরের ভিতরে শয়ন করেন শুকদেব স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আর দীনদাস এবং বসন্তদাসকে বাইরে রাত্রিযাপন করতে হয়। ফলে স্বামী–স্ত্রীর একান্ত হবার সুযোগ প্রায় একেবারেই নেই। মায়াবতীর অস্থিরতার এক কারণ সে অন্তঃসত্ত্বা। তার স্বামীসঙ্গ প্রয়োজন। একেকদিন নির্লজ্জ রমণীর মতো দ্বিপ্রহরে স্বামীকে সে কুটিরের ভিতরে ডাকে। দুবাহুতে স্বামীকে কণ্ঠলগ্ন করে বলে, তুমি আমাকে নিয়ে চলোতোমাকে আমি সর্বক্ষণ পাই না–এখানে থাকলে কখনই পাবো না–আমি এখানে থাকবো না।
বসন্তদাস নির্বোধের মতো আচরণ করে। অস্থির আবেগময়ী স্ত্রীকে সে শান্ত করতে পারে না। একেক সময় বহুক্ষণ রোদন করতে থাকলে বিরক্তি, ক্রোধ, ক্ষোভ ইত্যাকার মানসিক প্রতিক্রিয়া যে হয় না তা নয়–কিন্তু তথাপি সে সংযত থাকে। এখন কোনো প্রকার অস্থিরতাকে সে প্রশ্রয় দেবে না।
ইতোমধ্যে একটি সংবাদ পাওয়া যায় যে, পুনর্ভবা তীরের মদনপুর গ্রামখানি যবনদের দ্বারা উপদ্রুত হয়েছে। তাতে শুকদেব চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার শক্তি নেই যে একাকী অতদূর যান। জামাতাকে বলেন, বসন্ত, দেখো, যদি প্ৰফুল্লের কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারো, ওর কন্যাটির জন্য আমার বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
বসন্তদাস কোনোদিন পান্থশালায় যায়, কোনোদিন হাটে যায় আর চারিদিকের অবস্থা দেখে। তার অস্পষ্ট মনে হয়–সময় ঘনিয়ে আসছে। আর বোধ হয় কিছু করতে পারলো না কেউ।
একদিন সুনন্দপুরের হাটেই সংবাদ পাওয়া গেলো যে মহাসামন্ত সুধীমিত্র বিল্বগ্রামে নেই। কোথায় গেছেন, কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে যে তিনি তীর্থে গেছেন, অন্য জনরব আবার এই যে, যবনাক্রমণ আসন্ন দেখে তিনি দক্ষিণ দেশে পলায়ন করেছেন।
মিত্রানন্দ ইতোমধ্যে একদিন কদম্বঘাটে ছায়াবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছে। সেখানেও নতুন সংবাদ এই যে, নদীপথে দক্ষিণগামী বৃহৎ নৌকার সংখ্যা অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামন্তপতিরাই শুধু নয় তাদের অনুচরদের পরিবারও দক্ষিণে এবং পূর্বে চলে যাচ্ছে। ঐ ঘাটেই সাক্ষাৎ হলো এক বৃদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে। তিনি দেখে এসেছেন পশ্চিমের গ্রামগুলি থেকেও লোক পলায়ন করছে। প্রত্যেকের মুখেই যবনাক্রমণের সংবাদ। হ্যাঁ, তিনিও শুনেছেন মদনপুর গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে। তবে আক্রমণকারীরা গ্রামখানি ধ্বংস করে দেয়নি। দুতিনটি যুবতী রমণী এবং কয়েকটি গাভী ও ছাগল নিয়ে গেছে। না, কেউ নিহত হয়নি। তবে যাবার সময় মন্দিরটি অপবিত্র করে গেছে। মন্দির প্রাঙ্গণে গো–হত্যা করে সেই গো–মাংস দগ্ধ করে ভক্ষণ করেছে–এবং ঐ মন্দিরেই নাকি রমণীদের বলাকার করা হয়েছে। তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন দুই আত্মঘাতিনী রমণীর মৃতদেহ। তৃতীয়টি নাকি পূর্ব থেকেই উন্মাদিনী ছিলোসে এখন পথে পথে ঘুরছে।
মিত্রানন্দ অস্থির হয়ে উঠেছেন মনে মনে। তাঁর ধারণা, এখনও কিছু করা সম্ভব। যবনেরা বহিরাগত, স্থানীয় লোকের সহায়তা না পেলে তাদের পক্ষে এদেশে অধিককাল থাকা সম্ভব হবে না। সে সুযোগের অপেক্ষায় রইলো।
মায়াবতী যেন অনুভব করে তার স্বামী উন্মন। উজুবটে যেমন মনে হতো–এ তার চাইতেও অধিক। সর্বক্ষণ যেন কী চিন্তা করে। একদিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ বললো, তুমি কি আবার চলে যাবে?