অভিমন্যুদাস তাহলে এই লোক, দীনদাস লোকটিকে দেখে নিলেন উত্তমরূপে।
সে তখনও বলে চলেছে–হেঁ হেঁ গুরুদেব, আমি কে? আমি তো নিমিত্ত মাত্র সবই ভবিতব্য বলতে হবে। ইনি আত্মীয়জন, শুকদেবের শ্যালক, কি প্রকারে যেতে দিই বলুন–হেঁ হেঁ হেঁ–আপনিই বলুন শুকদেবের সংবাদ নিতে হবে না? তার জামাতাটির জন্য কতো ব্যাকুল আমরা।
অভিমন্যুদাস, সোমজিৎ বুঝিয়ে বললেন, দেখো, তুমি অহেতুক এঁর উপর উপদ্রব সৃষ্টি করেছো–এঁকে যেতে দাও–আমি উত্তম মতো জানি, এ কোনো প্রকার দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়।
কিন্তু অভিমন্যুদাসের দন্তবিকাশের শেষ নেই। অনবরত হেঁ হেঁ রবে হেসে যাচ্ছে। শেষে জানালো, আমার প্রভু হরিসেন কিন্তু আপনার উপরও দৃষ্টি রাখতে বলেছেন, হেঁ হেঁ গুরুদেব। আপনার ভাবগতিকও নাকি সুবিধার নয়। কী যে বলেন, রাজপুরুষেরা, তাই না গুরুদেব? হেঁ হেঁ, কিছুই বোধগম্য হয় না, তাই না? আসুন আপনি, আমার সঙ্গে আসুন।
সোমজিৎ কিছুই বলতে পারলেন না। দীনদাস তাঁর মুখের দিকে চাইলে তিনি শুধু বললেন, তুমি আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করো না–আমি বৃদ্ধ।
দীনদাস ততক্ষণে বুঝে নিয়েছেন, তাঁর সমূহ বিপদ। তিনি মহাসামন্ত হরিসেনের এক উন্মাদপ্রায় বিকৃত–বুদ্ধি লোকের হাতে পড়েছেন, তার আর আশা নেই। তিনি ইতি কর্তব্য স্থির করে নিলেন। অভিমদাসের খর্বাকৃতি দেহাবয়বটি আপাদমস্তক দেখলেন, দূরে যে গৃহের দিকে অভিমন্যু তাকে নিয়ে যেতে চায় সেই গৃহখানি দেখলেন, তারপর মনে মনে বললেন, দীনদাস, এবার তোমার ইষ্ট নাম জপ করার সময় হয়েছে–যদি কিছু করতে চাও, তো এখনই করো।
সোমজিৎকে বললেন, গুরুদেব চলুন, আপনার গৃহে জলপান করি প্রথমে, তারপর অভিমন্যুদাসের গৃহে যাবো–দেখি কী প্রকার সমাদর করে সে।
অভিমন্যু দন্ত বিকাশ করে হাসে শুধু।
সোমজিতের গৃহের বহির্দ্বারে গৃহ সংস্কারের নানাবিধ উপকরণাদি সংগ্রহ করে রাখা ছিলো। দীনদাস বহির্দ্বারের নিকটে এসে অভাবিত এবং দুঃসাহসী কাজটি করলেন। কারও কিছু বোধগম্য হবার পূর্বেই তিনি একখানি বংশখণ্ড হাতে তুলে নিলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে আঘাত করলেন। কি হলো বুঝতে পারেননি সোমজিৎ। যখন বুঝলেন, তখন দেখেন, অভিমন্যুদাস ভূমিতে পপাত এবং দীনদাস অনতিদূরে ধাবমান।
ঐ ঘটনার পর দীনদাসের ঐ অঞ্চলে থাকবার কথা নয়–এবং তিনি ছিলেনও না। কিন্তু অভিমন্যুদাস নিজ সঙ্গীদের নিয়ে উদয়পুর পর্যন্ত যেতে বিলম্ব করেনি। সেখানে কি হতো বলা যায় না। কেননা দীনদাসকে না পেয়ে অভিমন্যুর লোকেরা তার গৃহে অগ্নিসংযোগ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো। ওদিকে আবার প্রস্তুত হয়েছিলো গ্রামবাসীরাও। অভিমন্যুদাস অবস্থা দেখে নিজ সঙ্গীদের নিবৃত্ত করে এবং উদয়পুর গ্রাম থেকে চলে আসে।
তার নানান গুণ। আচরণে সে অত্যধিক ভদ্র এবং বিনয়ী। প্রথম আলাপে তাকে নির্বোধও মনে হতে পারে। কেউ কেউ বলে, সে নাকি নপুংসক। কিন্তু যে পরিচিতি, সে জানে কি প্রকার চতুর এবং কৌশলী সে। অমন নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা সচরাচর দেখা যায় না। হরিসেনের বিশ্বাসভাজন হয়েছে সে এই গুণটির জন্য। তার মস্তিষ্ক কখনই তপ্ত হয় না। সে এক উদ্দেশ্য নিয়ে বৎসরের পর বৎসর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে।
দীনদাসের জন্যও অপেক্ষা করতে পারবে, মনে মনে সে সিদ্ধান্তগ্রহণ করে। তার এক অপেক্ষা সেই অপরিচিত কুম্ভকার যুবকটির জন্য, উজুবটে অগ্নিসংযোগের রাত্রে যাকে সে লীলাবতীর সঙ্গে পলায়ন করতে দেখেছিলো, আর দ্বিতীয় অপেক্ষা, এই দীনদাসের জন্য। তার নিশ্চিত ধারণা, লীলাবতী একদিন না একদিন উজুবট গ্রামে আসবে। সে না আসুক, ঐ যুবকটি আসবে আর দীনদাসকে তো উদয়পুর আসতেই হবে। কেননা ঐ গ্রামে তার গৃহ-সংসার।
দীন অভাজন ব্যক্তি সে, মস্তকাবনত করে যতোদিন প্রয়োজন, সে অপেক্ষা করে থাকবে।
অপেক্ষা করার প্রয়োজন হতো না। মহাসামন্তের শস্ত্রধারী সুশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে ঐ লগুড়ধারী গ্রামবাসীদের তুলনা? সে চিন্তা করে দেখেছে। ও তো মাত্রই এক রাত্রির ব্যাপার, গ্রামখানির চিহ্ন পর্যন্ত থাকতো না। তবে সময় এখন অন্যরূপ। বলা যায় না, কখন যবন অশ্বারোহীদের উপদ্রব এসে উপস্থিত হয়। কেমন করে যে তারা সংবাদ পায় ভগবান, জানেন। কোন স্থান থেকে আসে, কোথায় যায়–কিছুই বলতে পারে না কেউ। না হলে লীলাবতী কি যুবাপুরুষটির হাত ধরে সেদিন ঐভাবে পলায়ন করতে পারে? যদি পশ্চাতে অশ্বারোহীটি ছুটে না আসতো, তাহলে একটি বর্শাঘাতের অপেক্ষামাত্র ছিলো। তারপর দেখা যেতো, লীলাবতীর অহঙ্কারখানি কত উচ্চ হয়েছে।
কিন্তু দেখা যায়নি শেষ পর্যন্ত। লীলাবতীর মাতুল সেই যোগী পুরুষটিকেও সে দেখতে চায়। আর শুকদেবের জামাতাটি, তাকেও তার প্রয়োজন। সুতরাং সে অপেক্ষা করবে।
কিন্তু কেন এই অপেক্ষা? কেউ–ই জানে না কিসের অপেক্ষায় দিন গণনা করছে। বরেন্দ্র–বঙ্গ–সমতটের জনপদগুলি। লোভ হিংসা প্রতিহিংসা প্রতারণা যুদ্ধ ধ্বংস প্রেম সমস্ত কিছু একাকার হয়ে অপেক্ষায় আছে সেই অনাগত প্রহরটির জন্য।
রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে গোবর্ধন আচার্য ও হলায়ুধ মিশ্রের মতো লোকেরা অপেক্ষায় আছেন–অপেক্ষায় আছেন উজুবট গ্রামের সোমজিৎ উপাধ্যায়–হরিসেনও সম্ভবত অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা বসন্তদাসের, লীলাবতীর, শ্যামাঙ্গের, ছায়াবতীর, শুকদেবের, মিত্রানন্দের। কার অপেক্ষা নয়? সকলেই উপলব্ধি করে, যে জীবনযাপিত হচ্ছে, সে জীবন থাকবে না–এই অস্থিরতার অবশ্যই অবসান হবে। কিন্তু সেই অবসান কিসে? মৃত্যুর হতাশায়? না নবীন জীবনের উন্মেষে? কেউ-ই বলতে পারে না।