অথচ ওদিকে ভগিনী যোগমায়া ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। মায়াবতী চিন্তায় চিন্তায় শীর্ণকায়া, শুকদেব তো প্রায় সর্বক্ষণই নীরব ও নির্জীব থাকেন। তবে সৌভাগ্য যে, জামাতা বসন্তদাসের সংবাদ পাওয়া গেছে, সে জীবিত এবং সুস্থ। দীনদাস জানেন, এই সংবাদটি শ্রবণ করলেই শুকদেব পুনরায় সচল ও সজীব হয়ে উঠবেন, যোগমায়ার মুখে হাসি ফুটবে এবং মায়াবতী হয়ে উঠবে চঞ্চলা হরিণীটির মতো–যেমন সে পূর্বে ছিলো।
যবনদের আগমন সংক্রান্ত সংবাদ তাকে কেউ-ই দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলে, তারা পশ্চিমে তঙ্গন নদীর পরপারে অবস্থান করছে, কেউ আবার বলে, তারা দক্ষিণ–পশ্চিমে মহানন্দার তীরে শিবির স্থাপন করে আছে–প্রকৃত সংবাদ কেউ জানে না। তবে স্বস্তির কথা এই যে, তাদের নতুন কোনো কার্যকলাপ দেখা যায়নি। কিন্তু একটি চিন্তার বিষয়ও আছে। শোনা যাচ্ছে যে, সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা নাকি সত্য সত্যই যবনদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
দীনদাসের বহু কাজ–প্রথমত মদনপুর গ্রামে শুকদেবের সুহৃদ প্রফুল্লদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। তারপর সন্ধান করতে হবে বসন্তদাসের। যদি সাক্ষাৎ হয় উত্তম, না হলে প্রফুল্লদাসের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করতে হবে, শুকদেব আর তাঁর স্ত্রী কন্যাকে কোথায় আনা যায়–নিজ গ্রামে উদয়পুরে, না প্রফুল্লদাসের গৃহ মদনপুরে।
শুকদেব উজুবটের ব্রাহ্মণপল্লীতেও যেতে বলেছেন। সোমজিৎ উপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অভিমতটি যেন সংগ্রহ করেন দীনদাস।
সোমজিৎ উপাধ্যায় বহির্বাটিতেই ছিলেন। দীনদাস প্রণাম করে সম্মুখে দাঁড়ালে জানতে চাইলেন, কে তুমি? তোমাকে তো পরিচিত মনে হচ্ছে না?
আজ্ঞে আমি উদয়পুরের লোক, এই গ্রামের ক্ষেত্রকর শুকদেব আমার ভগিনীপতি।
শুকদেবের নাম শুনে সোমজিৎ আগ্রহী হলেন। বললেন, শুকদেব কোথায়? তার কি সংবাদ, কুশলে আছে তো?
দীনদাস সত্য গোপন করলেন। বললেন, তিনি আমার গৃহে আছেন। শরীর অসুস্থ, বৃদ্ধ হয়েছেন তো–তিনি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। আপনার পরামর্শ চান শুকদেব, তিনি কি উজুবটে ফিরে আসবেন? আপনি বললেই তিনি আসবেন।
সোমজিৎ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন একটি। কী বলবেন? এই অপরিচিত ক্ষেত্ৰকরটির কাছে কি বলা যায়, রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে তিনি কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন? বলবেন কি, যে মহাসামন্ত হরিসেনের স্বেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ নেই। তিনি আপন মনে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, শুকদেব পরমকুটুম্বের গৃহে গেছে, সেখানে থাক কিছুদিন, এতো শীঘ প্রত্যাবর্তনের কি প্রয়োজন? নাকি শ্যালক শ্যালক–পত্নী যথেষ্ট সমাদর করছেন না।
ঈষৎ কৌতুকে হাস্য করলেন কথাটি বলে। শেষে জানালেন, শুকদেবকে আগমনের পরামর্শ আমি দেবো না, কারণ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, দেহবল মনোবল উভয়ই আমার গত প্রায়। তবে যদি আগমন করতেই হয়, তাহলে তাকে বলল সে যেন আমার গৃহের নিকটে কুটির নির্মাণ করে থাকে। ঐ যে ব্রাহ্মণপল্লীর সীমানা দেখছো, সোমজিৎ হাত তুলে দেখালেন। বললেন, তারপরই আমার দুই কূলব্যাপ ভূমি–ঐ স্থানে আরও দুটি পরিবার গৃহ নির্মাণ করে আছে–শুকদেব এলে ওখানেই তাকে গৃহ নির্মাণ করতে হবে, তার নিজের পল্লীতে বসবাস এখনও বিপজ্জনক।
উপাধ্যায় মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে একটি লোক তার সম্মুখে দাঁড়ালো। তারপর আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করে বললো, মহাশয়কে নতুন দেখছি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, আমি উদয়পুরের লোক, আপনি?
আমি এই গ্রামেরই লোক, একজন দীন অভাজন বলতে পারেন।
দীনদাস লক্ষ্য করলেন লোকটির দৃষ্টি অদ্ভুত। বিনয়ে মুখখানি নত। কিন্তু যখন দৃষ্টি তোলে তখন চক্ষু দুটির বহুদূর ভেতরে কপিশবর্ণের আলোকরেখা দেখা যায় একটি। যেন বিষধর সর্পের দৃষ্টি।
তা মহাশয় বুঝি উপাধ্যায় মহাশয়ের ক্ষেত্রকর? লোকটি জানতে চায়।
না, আমি নই, আমার ভগ্নীপতি তার ক্ষেত্রকর।
ও, তাই হবে, আপনি তাঁর ক্ষেত্রকর হলে তো নিশ্চয়ই আপনাকে পূর্বে দেখতাম। আমি নির্বোধ, জানেন, সকলেই আমাকে উন্মাদ বলে। কখন কোন কথা বলি কিছুরই স্থিরতা নেই–তা মহাশয়ের ভগ্নীপতিটির পরিচয় তো জানা হলো না?
দীনদাস দেখলেন, লোকটি সুবিধার নয়। বললেন, আমার ভগ্নীপতির নাম শুকদেব, এবার পথ ছাড়ুন, আমি যাবো।
কি যে বলেন, হেঁ হেঁ কি যে বলেন–শুকদেব আমার শ্বশুর স্থানীয় ব্যক্তি। তার আত্মীয় হলে তো আপনি আমারও আত্মীয়–আপনাকে এভাবে পথ থেকেই যেতে দিই কীভাবে–হেঁ হেঁ–আপনি গুরুজন, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন, শুকদেব কোথায় আছেন? কেমন আছেন? তার জন্য আমরা এতো উদ্বিগ্ন যে বলার কথা নয়। তার কন্যা মায়াবতী কোথায়? তার জামাতা বসন্তদাস কোথায়?
দীনদাস বুঝলেন, সমস্তই লোকটির অভিনয়, নিশ্চয় সে হরিসেনের অনুচর। তিনি সাবধান হলেন। বললেন, আমি মদনপুরে প্রফুল্লদাসের কাছে যাচ্ছি, এখানে উপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সমাপ্ত হয়নি–সন্ধ্যাকালে আবার হবে–রাত্রি আমি তার গৃহেই যাপন করবো, আর বিলম্ব করাবেন না–যেতে দিন।
অবশ্যই যাবেন, হেঁ হেঁ, বিলম্ব করা আদৌ উচিত নয়, ঐ যে আমার কুটির, বড় অভাজন আমি, যদি পদধূলি দিতেন একবার, এ দীন অভাজন ধন্য হতো।
সোমজিৎ দূর থেকে দেখছিলেন ব্যাপারটি। তিনি সম্মুখে এলেন। জানতে চাইলেন, কি হয়েছে অভিমন্যুদাস? এঁকে তুমি যেতে দিচ্ছো না কেন?