বাইরে উন্মথিত রাত্রি অতিবাহিত হয়। দক্ষিণে বামে দোল খায় মহাকাশের তারকামালা, অনাহত ডমরু ধ্বনির মত স্পন্দিত হয় জগতের প্রাণ স্পন্দন–আর সেই সঙ্গে লীলাবতী যেন তার অনিশ্চিত অস্তিত্বের মধ্যে একটি মূলের সন্ধান পেয়ে যায়। নিজেকে সে নিঃশেষে নিবেদন করে। তার মনে হয়, এরপরে যদি মৃত্যু হয়, তো হোক। জীবনের মর্মে কোথায় যেন সে নিজেকে প্রোথিত বোধ করে।
এক সময় দুজনেরই সম্বিত ফেরে। লীলাবতী শ্যামাঙ্গের কণ্ঠ বেষ্টন করে মৃদু স্বরে বলে, দস্যু কোথাকার, সমস্তই তো হরণ করলে–এবার?
শ্যামাঙ্গ জানায়–চলো, এ স্থান ত্যাগ করি। আর এখানে নয়।
রাত্রির মধ্য প্রহরে তারা পথে নামে এবং যাত্রা করে পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে। কিঞ্চিদধিক দুই দণ্ডকালের পথ। যখন নগরীতে উপনীত হয় তখন প্রত্যুষকাল। এক প্রাচীন নির্জন অট্টালিকার বহিরলিন্দে দুজনে অপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের। সূর্যোদয় হলেই তারা কোনো পান্থশালা সন্ধান করে নেবে। এবং ঐ সময়ই প্রমত্ত মাদকসেবীদের একটি ক্ষুদ্র দল ঐ স্থানে উপনীত হয়। একাকী যুবতী ও গ্রাম্য পুরুষ দেখলে নগরবাসী তস্করেরা যা চিন্তা করে–এরাও সেই চিন্তা করলো। সামান্য কথায় বচসা হলো এবং সেইসূত্রে শ্যামাঙ্গকে আহত ও সংজ্ঞাহীন করে লীলাবতীকে স্কন্ধে তুলে নিয়ে তারা ধাবমান হলো। লীলাবতী তখন প্রাণপণ চিৎকার করে। ঐ সময়ই সে দেখে দীর্ঘ পরিচ্ছদধারী শ্মশ্রুমণ্ডিত–মুখ কয়েকজন লোক ছুটে আসছে। তাদের আসতে দেখে তস্করের দল লীলাবতীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে পলায়ন করলো। লীলাবতী তখনও চিৎকার করছিলো। একজন নিকটে এসে জানালো, ভয় নেই ভগিনী–আর ভয় নেই, তুমি কে? কোথায় যাবে?
অতঃপর লীলাবতীর নতুন আশ্রয় হলো পুন্ড্রনগরীর যবন কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রের লোকেরাই আহত, অচেতন, শ্যামাঙ্গকে সন্ধান করে নিয়ে আসে এবং চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে।
১১. দীনদাস স্বগৃহে এসেছেন
দীনদাস স্বগৃহে এসেছেন। তারপর পক্ষকাল গত। ইতোমধ্যে তিনি উজুবটেও গিয়েছিলেন। ভস্মীভূত ক্ষেত্রকর পল্লীটিতে এখন আর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় না। বাতাস এবং বৃষ্টি ভস্ম ও অঙ্গারগুলি মৃত্তিকার সঙ্গে মিশ্রিত করে দিয়েছে। তদুপরি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরুলতার আবির্ভাবে এমন হয়েছে স্থানটি, যে ঈষদুচ্চ গৃহ–পীঠগুলি না থাকলে অনুমানই করা যেতো না যে একদা এই স্থানে একটি সমৃদ্ধ পল্লী ছিলো।
শুনেছিলেন কোনো কোনো পল্লীবাসী ফিরে এসে পুনরায় গৃহ নির্মাণ করেছে। কিন্তু দেখলেন, কথাটি জনরব মাত্র। দুএকখানি গৃহ অবশ্য উঠেছে কিন্তু ঐ স্থানে নয় কিঞ্চিৎ দূরবর্তী স্থানে, ব্রাহ্মণপল্লীর একেবারে প্রান্তসীমায় সংলগ্ন। বোঝা যায়, ব্রাহ্মণরাই ব্যবস্থাটি করেছেন। দাস ভৃত্য না হলে তাঁদের চলবে কীভাবে?
তিনি বহু সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। যেমন মহাসামন্ত হরিসেন রাজধানীতে ছিলেন মাসাধিককাল। সেখান থেকে এসে তার প্রতাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রক্ষা এই যে, এখনও নতুন কোনো ঘটনা ঘটাননি। কেবল তাঁর চরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেত্রকরদের নিশ্চিহ্ন পল্লীটির উপর এখনও তাঁর ক্রোধ। তাঁর নাকি অনুমান ঐ পল্লীর লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো যুগপৎ যবন ও সদ্ধর্মীদের। তাদেরই ষড়যন্ত্রের কারণে যবনেরা হরিসেনের বাহিনীকে আঘাত করে। ঘটনাটির কথা যতোবার স্মরণ হয় ততোবারই নাকি তাঁর ক্রোধ উদ্দীপ্ত হয়। ঐ পল্লীর শিশু বৃদ্ধ রমণী কাউকেই তিনি জীবিত রাখতে চান না। শোনা যায়, একটি কিশোর বালককে বন্দী করা হয়েছিলো সেই বালকটিকে সন্ধান করে আর কেউ পায়নি। কাজটি নাকি অভিমন্যুদাসের। এই লোকটি এখন হরিসেনের দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠেছে। যাবতীয় দুষ্কর্ম এখন অভিমন্যুদাসই সম্পাদন করে। সে উজুবটের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে চর নিয়োগ করে রেখেছে–ভিক্ষু অথবা যোগী বলে কোনো লোককে সন্দেহ হলেই তারা যেন সংবাদ দেয়। সে যোগী এবং ভিক্ষুদের লাঞ্ছনা করতে অত্যধিক আগ্রহী। ঐ কাজে সে যারপরনাই আনন্দ পায়। এও শোনা যায় যে হরকান্ত ও তার কন্যাটির সে সন্ধান করছে। হরকান্তের গৃহে একটি যোগী এসেছিলেন, সেই যোগীটিকেও নাকি তার বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নাকি আরও একটি কুম্ভকার যুবকের সন্ধান করছে সে। দীনদাসের অনুমান, এই কুম্ভকার যুবক শ্যামাঙ্গ ব্যতীত আর কেউ নয়। শ্যামাঙ্গের যে কী অপরাধ তিনি ভেবে পান না।
দীনদাস এতো সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন এই জন্য যে, এই সকল সংবাদের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বগ্রামে শুকদেবের প্রত্যাবর্তন সমীচীন কিনা। যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে অন্য কোথাও গৃহ নির্মাণ করতে হবে–তা সে যে স্থানেই হোক। দূরদেশে অন্যের আশ্রয়ে কতোদিন থাকবেন। সর্বোপরি জামাতা বসন্তদাস সম্পর্কে হরিসেনের অনুচরদের কি মনোভাব সেইটি জানা অধিক প্রয়োজন। কেননা বসন্তদাসের সঙ্গে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সংস্রবের সংবাদটি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। এবং হরিসেনের অনুচরেরা যে উজুবটের ক্ষেত্রকর পল্লীটি আক্রমণ করে, তাও কিন্তু বসন্তদাসকে বন্দী করার জন্যই। এমতাবস্থায় বসন্তদাসের প্রতি হরিসেন ও তার অনুচরদের মনোভাবের। পরিবর্তন যদি না ঘটে, তাহলে শুকদেবের উজুবট গ্রাম তো দূর স্থান, এতদঞ্চলেই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।