ঐ পর্যন্তই–-লীলাবতীর সমগ্র অস্তিত্ব স্তব্ধ হয়ে যায়–আকাঙ্ক্ষায় না ঘৃণায় বলা দুষ্কর। শ্যামাঙ্গ আর অগ্রসর হয় না। সে শয্যায় দেহ রাখে এবং লীলাবতী তার ভূমি শয্যায় ফিরে যায়।
পরদিন তারা শয্যা ত্যাগ করে বিলম্বে। প্রকোষ্ঠের বাইরে এসে দাঁড়ালে অধিকারীটি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। জানতে চায়, মহাশয়ের বোধ হয় জাগরণে রাত্রি অতিবাহিত হয়েছে?
শ্যামাঙ্গের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। জানতে চায়, কেন–একথা কেন বলছেন–কেন আমরা রাত্রি জাগরণ করবো?
হেঁ হেঁ হেঁ, ক্রুদ্ধ হবেন না মহাশয়, লোকটি বিনয়ে বিগলিত হতে আরম্ভ করে। বলে, সমস্ত রাত্রি আপনারা আলাপ করেছেন তো, তাই বলছি
শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে প্রৌঢ়টির দৃষ্টি যেমন, তেমনি হাসিটিও কদর্য। তার ক্রোধ হয়। বলে, আপনি দেখছি ছিদ্রান্বেষী–ছিদ্রপথে অন্যের গোপন ক্রিয়াকলাপ দেখে থাকেন।
না না ওকথা বলবেন না, আমার বয়স হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছেন
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, বৃদ্ধ শালিক পক্ষীর গ্রীবায় নতুন পালকের উদগম হয়েছে, শ্যামাঙ্গ নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।
হেঁ হেঁ আপনি দেখছি রসিকও, প্রৌঢ়টির চাটুকারিতা দেখবার মতো। লীলাবতীর দিকে ইঙ্গিত করে বলে, তা ইনি কি আপনার বিবাহিতা পত্নী?
শ্যামাঙ্গ বুঝলো, লোকটি অসম্ভব ধূর্ত এবং বদ–স্বভাব। সে সংযত হলো, কে জানে, এই বদলোক কোন গোলযোগ সৃষ্টি করে। বললো, ইনি আমার সহধর্মিণী–আমরা যোব্রতী।
হেঁ হেঁ, তাই বলুন, আমার সন্দেহ তাহলে অমূলক নয়–আপনারা যোগী। যোগ সাধনায় সঙ্গিনীর অবশ্যই প্রয়োজন, হেঁ হেঁ–তা এই কথাটা পূর্বে বললে হতো না?
কোন কথা? শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত বোধ করে।
এই যে, আপনারা যোগী, আমার গৃহে রাত্রিকালে যোগ সাধনা করবেন? ছি ছি কি অনাচার। এখন আমাকে গৃহশুদ্ধি করতে হবে। দেখুন তো, আপনারা আমার কি সর্বনাশ করেছেন?
শ্যামাঙ্গ অনুমান করে প্রৌঢ়টি তাকে বিপদাপন্ন করবে। সে বললো, মহাশয়, এতো বিচলিত হচ্ছেন কেন? আমরা তো রাত্রিযাপনের জন্য অর্থ দিচ্ছিই, সেই সঙ্গে না হয় আরও কিছু অধিক দেবো।
ঐ কথায় কাজ হয়, প্রৌঢ়টি শান্ত হয়। কিন্তু তার মুখ শান্ত হয় না। তখন তার আবার অন্যরূপ বিনয়। বলতে লাগলো, আমার দোষ নেবেন না মহাশয়, গৃহশুদ্ধি আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়–এ গ্রামের সমাজপতিরা শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারে অত্যধিক তৎপর থাকেন। সামান্য ত্রুটি হলেই তারা সমাজে পতিত ঘোষণা করে দেন, সুতরাং বুঝতেই পারছেন…
শ্যামাঙ্গ জানতে চাইলোতা আপনারা কি শূদ্রের মধ্যেও জলাচল শ্রেণীভেদ করে রেখেছেন নাকি?
না তা করিনি?
তাহলে যোগী স্পর্শে গৃহশুদ্ধি করতে হবে কেন?
আমি তো বৈশ্য, অম্বো০ষ্ঠ বৈশ্য।
শ্যামাঙ্গের বিশ্বাস হতে চায় না। বলে, আপনি অঘোষ্ঠ বৈশ্য হলে পান্থশালার রক্ষক হন কি প্রকারে?
মহাশয় আর বলবেন না, সবই সমাজপতিদের ইচ্ছা। সামাজিক যতো বিধান, সবই তাঁদের প্রয়োজনে। ব্রাহ্মণ যখন কুলবৃত্তি যজ্ঞ–যাজনাদি ত্যাগ করে রাজকার্য করে, তখন কেউ তাদের দোষ দেয় না, বরং ঐ নববৃত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন কুলের উদ্ভাবন করা হয়। ব্রাহ্মণ হয়ে যায় ব্রহ্মক্ষত্রিয়–আমার ক্ষেত্রেও ঐ প্রকার ব্যবস্থা হয়েছে আর কি! গ্রামপতি ও ব্রাহ্মণরা বললেন যে, তোমার পান্থশালা–রক্ষক হতে বাধা নেই। কারণ তোমার বৈদ্য পিতা যা করেন, তোমার কাজও তাই। তিনি রুগ্ন মানুষের সেবা করেন। আর তুমি করবে শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষের সেবা–সুতরাং বাধা কোথায়? তাই অঘোষ্ঠ বৈশ্য হয়েও আমরা পান্থশালার অধিকারী।
শ্যামাঙ্গ ততক্ষণে মনস্থির করে নিয়েছে–আর এক মুহূর্ত নয় এ স্থানে। প্রৌঢ়ের কথা শেষ হলে সে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি উর্ধ্বে তুলে বললো, আপনারা প্রকৃত কী, জানেন? আপনারা হচ্ছেন অশ্বডিম্ব–বুঝলেন? উৎকৃষ্ট এবং সুগোলাকার একটি অশ্বডিম্ব।
প্রাপ্তিটি অভাবিতপূর্ব এবং অত্যধিক। এক রাত্রির জন্য একেবারে একটি সম্পূর্ণ মুদ্রা! প্রৌঢ়টি সবিস্ময়ে নিজের প্রসারিত হস্তপানে চেয়ে থাকে। তার ধারণা হয়, লোকটি নিশ্চয়ই উন্মাদ।
পথে লীলাবতী জানায়, দেখলে তো আমাদের স্থান কোথায়? গৃহে অবস্থান করলে লোকে গৃহশুদ্ধি করে।
সে তো করবেই, যোগীদের অনেকেই ঘৃণ্য মনে করে। তুমি যোগী–এই পরিচয় ব্যতিরেকে অন্য আর কী পরিচয় দিতে পারতে?
কেন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলে হতো না?
শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়। তার ধারণা ছিলো না যে ঐ পরিচয়দানের জন্য লীলাবতী এখন প্রস্তুত! বললো, উত্তম কথা, এবার থেকে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়টিই প্রচার করবো।
১০. করতোয়া তীরে এসে
করতোয়া তীরে এসে উপনীত হয় তারা এক প্রকার নির্বিঘ্নেই। নদীতীরেই একখানি গ্রাম, সেখানে কুম্ভকারদের বাস। ঐ গ্রামে সহজেই তারা স্থান পায়। প্রবীণ কুম্ভকার অবনীদাস সম্পন্ন গৃহস্থ! তাঁরই আশ্রয়, কুটিরটিও তাঁরই। অবনীদাসের লোকের প্রয়োজন ছিলো, তাই তিনি শ্যামাঙ্গকে সাদরে স্থান দিয়েছেন।
বর্ষা গত হয়েছে, শরৎ আসন্ন, তাই ব্যস্ততাও অধিক। মধুপুর গ্রামখানি পুন্ড্রনগরী থেকে মাত্রই দুই ক্রোশ। ফলে নগরীর প্রয়োজনীয় তৈজসাদি অধিকাংশই এই গ্রাম থেকে যায়।
শ্যামাঙ্গ সহজেই নিজেকে কর্মব্যস্ততার সঙ্গে যুক্ত করে। বাহির থেকে মনে হয়, দম্পতিটির জীবন ভারী সুখী। নবীনা গৃহিণীটি সর্বক্ষণ সংসার–কর্মে ব্যস্ত। কখনও অঙ্গন লেপন করছে, কখনও নদী থেকে জল আনছে, কখনও রন্ধন করছে। প্রতিবেশিনীরা দেখে বধূটি নিতান্তই স্বল্পভাষিণী। প্রশ্ন ব্যতিরেকে কোনো কথাই বলে না। যদি পিতৃগৃহের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে তার ক্ষুদ্র উত্তর, আমার পিতা–মাতা নেই, কেবল একজন মাতুল আছেন। শ্বশুরগৃহের কথা জানতে চাইলে বলে, তাঁরাও গত হয়েছেন, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্য। বিবাহ কতোদিন, সন্তানাদি কি একেবারেই হয়নি, দেশত্যাগ কেন করেছো–ইত্যাকার প্রশ্ন হলে সে উত্তর দেয় না, অধোমুখে নিজ কাজে অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠে।