লীলাবতী কিছু বললো না। স্থাণু মূর্তির মতো দীর্ঘক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।
শ্যামাঙ্গ কী বলবে ভেবে পায় না। যদি সে শয্যায় শয়ন করে, তাহলে লীলাবতীর ধারণা হবে যে সে লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী, আর যদি ভূমিতে রাত্রিযাপন করে, তাহলে লীলাবতী শয্যায় শয়ান হয়ে সমস্ত রাত্রি অস্বস্তি বোধ করবে। সে পুনরায় বললো, লীলা, তুমি শয়ন করো, রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।
লীলাবতী গুণ্ঠন উন্মোচন করে বলে, তুমি শয়ন করবে ভূমিতে আর আমি শয়ন করবো শয্যায়? এ কথা চিন্তা করবার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
এ তো মহাজ্বালা! শ্যামাঙ্গ উঠে দাঁড়ায়। বলে, তুমি আমাকে কী করতে বলো?
তুমি শয্যায় শয়ন করো, আমি ভূমিতে থাকি।
তোমার এ ব্যবস্থাই বা আমি মানবো কেন?
শ্যামাঙ্গের এই কথায় লীলাবতী ঈষৎ কুপিতা হয়। বলে, উত্তম কথা, তুমি মেনন না–এসো, তাহলে অশ্বের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে নিদ্রা যাই।
না, তা কেন?
কেন নয়, তাহলে কি বলতে চাও দুজনেই এক শয্যায় রাত্রিযাপন করবো? যদি ঐরূপই তোমার ইচ্ছা থাকে, তাহলে বলো–আমি সেইভাবে রাত্রিযাপনের জন্য প্রস্তুত হই।
ক্লান্ত অবসন্ন দেহে মধ্যরাত্রে বাদানুবাদে শ্যামাঙ্গের প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। তার চক্ষু দুটি মুদিত হয়ে আসছিলো। ফলে আর সে কথা বললো না, শয্যায় নিজেকে নিক্ষেপ করলোএবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়, বলা যায়, সে নিদ্রায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো।
তৈলদীপ কখন নির্বাপিত হয়েছে জানে না। গভীর রাত্রে অনুভব করলো একখানি কোমল হাত তার কেশ বিলুলিত করছে। সে নিদ্রার ভান করে রইলো। এক সময় অনুভব হলো, হাত নয়, দুটি ওষ্ঠ তার কপাল চুম্বন করছে। এবং ঐ মুহূর্তে সে দুবাহুতে গলদেশ বেষ্টন করে নিজের মুখখানি লীলাবতীর পরিপূর্ণ বক্ষে নিমজ্জিত করলো। শ্যামাঙ্গের ঐ আচরণে মুহূর্তের জন্য যেন বিমূঢ় হলো লীলাবতী। সজোরে নিজেকে মুক্ত করে ভারাক্রান্ত স্বরে বললো, ছাড়ো আমাকে শ্যামাঙ্গ, আমাকে তুমি এভাবে প্রলুব্ধ করো না।
ঐ মুহূর্তে দুই বিন্দু অশ্রু কপোলে এসে পড়লে সে চমকিত হয়। বলে, কি ব্যাপার, লীলা, তুমি কাঁদছো কেন?
রুদ্ধবাক লীলার দমিত কান্না ঐ কথার পর যেন সকল সংযমের বাধা অতিক্রম করে। সে শ্যামাঙ্গের বক্ষে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। শ্যামাঙ্গ নির্বাক। সর্বস্বহৃতা এই রমণীকে সে কী বলবে? আত্মীয়–পরিজনহীন, বর্তমান ভবিষ্যৎহীন, এই নারীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কি কোনো ভাষা রচিত হয়েছে কোথাও? সে জানে না। বারংবার সে একটি কথাই বলতে পারলো। আর তা হলো, কেঁদো না লীলা, জীবন যেভাবে এসেছে সেভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে না হলে আমাদের মরণ।
গবাক্ষ পথে চন্দ্রালোকের আভা প্রকোষ্ঠে আসছিলো। তাতে লীলার অশ্রুসিক্ত মুখখানি, উজ্জ্বল চোখ দুটি, চন্দ্রকলার মতো কপালখানি, ভারী সুন্দর হয়ে অন্ধকারের মধ্যে ফুটে উঠলো। কান্নায় তার অধরোষ্ঠ স্ফুরিত হলো বারেক, বারেক তার অশ্রুময় চোখের দৃষ্টি বাহিরের শীতল জ্যোৎস্নায় অবগাহন করলো–তারপর সে বললো, শ্যামাঙ্গ, তুমি আমাকে ত্যাগ করে যাও–আমার ক্ষমতা নেই যে আমি তোমাকে গ্রহণ করি যখনই তুমি আমার দিকে চাও, তখনই নিজেকে অপরাধী মনে হয়–কিন্তু তবু আমি নিজেকে নিঃশেষে দান করতে পারি না। কখনও দেহ উন্মুখ হয়, কখনও মন। বড় জটিল অবস্থা আমার তুমি আমাকে ত্যাগ করো।
শ্যামাঙ্গ হাসে। বলে উত্তম কথা, ত্যাগ না হয় করলাম। অতঃপর তুমি কোথায় যাবে?
আমি জানি না, শ্যামাঙ্গ, পুনরায় লীলার কান্না উদ্বেলিত হয়। বলে, যখনই তুমি আমার দেহে হাত রাখো, তখনই যেন মনে হয় এক লম্পট আমার দেহে হাত রাখছে। যখনই তুমি আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাও, মনে হয় তুমি দেহ সম্ভোগের পরিকল্পনা করছো। মনে হয়, কেবল ঐ একটি কারণের জন্য সঙ্গে সঙ্গে চলেছো তুমি। বরং তুমি যদি এমন না হয়ে অন্যদের মতো হতে, যদি কোনো বাধা না মেনে আমাকে বলাকার করতে–তাহলে যেন ছিলো ভালো। আমি তোমাকে ভাবতে পারতাম লম্পট, লোভী এবং স্বার্থান্বেষী বলে, এবং তাহলে তোমাকে আমি ঘৃণা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তুমি তা নও। তুমি এতো ভালো, মুখপানে চাইলে তোমার পদতলে নিজেকে নিবেদন করার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু নিকটে গেলেই আর পারি না। তুমি যাও প্রিয়তম। আমার ললাটে যা আছে তাই হবে–আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারবো না।
ঐ সময় শ্যামাঙ্গ উঠে বসে লীলাবতীর স্কন্ধে হাত রাখে। বলে, তুমি কি উন্মাদিনী হয়েছো? এমন অদ্ভুত কথা কেন বলছো? দেখো আমার চক্ষু দুটির দিকে। এই মুহূর্তে আমার কী ইচ্ছা করছে, জানো? ইচ্ছা করছে তোমাকে চুম্বন করি, বক্ষে পিষ্ট করি এবং তারপর প্রাণভরে তোমাকে সম্ভোগ করি–কিন্তু আমি তা করছি না–কারণ জানো?
কী? বলো, কী? লীলাবতীর চক্ষু দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
শ্যামাঙ্গ জানায়, আমি যে তোমাকে হৃদয় দান করেছি–আমি কেন লম্পটের মতো অপহরণ করবো? প্রেম নিঃশেষে নিবেদন করার–তাই আমি অপেক্ষা করে আছি।
বলো না শ্যামাঙ্গ। ওভাবে বলো না–আমি জটিল হয়ে পড়েছি–আমাকে উন্মাদিনী জ্ঞান করে ত্যাগ করো।
তবে রে রমণী, ফের ঐ কথা? হঠাৎ শ্যামাঙ্গ ক্রোধের ভান করে। বলে, দেখ তবে জীবন কাকে বলে–এই বলতে বলতে সে দুবাহুতে সজোরে বেষ্টন করে লীলাবতীকে এবং তারপর তার অধরোষ্ঠে পরিপূর্ণ এবং দীর্ঘ একটি চুম্বন দান করে।