ঐ সময় সে দূরে দেখতে পায় দুজন লোক আসছে। লোক দুটিকে এক সময় হঠাৎ ধাবমান হতে দেখে তার সন্দেহ হলো। এবং পরক্ষণেই তাদের হাতের অস্ত্র দুখানিও দৃষ্টিতে এলো। সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই, সুতরাং সে আর কোনো প্রকার বিলম্ব করতে পারে না। দ্রুত নদীতীরে এসে নৌকাখানি নিয়ে সে পশ্চিমতীরে চলে এলো। দেখলো, হড়ডি বৃদ্ধটির কথাই যথার্থ। পূর্বতীরে তার বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে।
তুমি এখন তবে কার? বৃক্ষছায়ার নীচে, হট্টকুটিরে অর্ধশয়ান অবস্থায় নিজেকে প্রশ্ন করে সে। তুমি কি পিতামাতার? নাকি প্রিয়তমা পত্নীর? নাকি সেই বালগ্রামের কৃষ্ণা নাম্নী মন্দিরদাসীটির?
সে যেমন এখন কারও নয়, তেমনই আবার নিজেরও নয়। তুমি কি তোমার বসন্তদাস? প্রশ্ন করে সে উত্তর পায় না। ব্যক্তির অস্তিত্ব তো সম্পর্কে–তা সে যেমনই হোক বস্তুসম্পর্ক হোক, অথবা হোক ব্যক্তিসম্পর্ক। আমি আমি বলে চিৎকার করলেই কি তাতে কিছু প্রমাণিত হয়? আমার এখন মানবসম্পর্ক নেই–পিতামাতা, আত্মীয়–পরিজন, স্ত্রী বন্ধু, কোনো সম্পর্কেই তো আমি এখন যুক্ত বোধ করি না। আর বস্তু সম্পর্ক? সেখানেও কি আমি যুক্ত? কোন পরিচয়টি আমার? আমি কি বণিক? বণিক হলে বিত্তহীন সম্বলহীন অবস্থায় আমি হট্টগৃহে একাকী শয়ান কেন? নাকি আমি ক্ষেত্ৰকর? তাহলে তো আমার গৃহবাসী হয়ে ক্ষেত্রকর্মে যুক্ত থাকার কথা।
না সে বণিক নয়। ঐ পরিচয় তার অপহৃত হয়ে গেছে ফরুগ্রাম জনপদে। এবং ক্ষেত্রকর পরিচয়টি ত্যক্ত হয়েছে আরও পূর্বে। এখন তাহলে কি সে ভূত্য? দাস? নাকি সাধু অথবা যোগী? সে নিজের জন্য কোনো অভিধা আবিষ্কার করতে পারে না। দুর্বাত্যা প্রবাহে উন্মুলিত ক্ষুদ্র পাদপের মতো অবস্থা তার। সে উপলব্ধি করে, এই অবস্থা তার একার নয়। প্রায় সকল মানুষেরই এই অবস্থা। তুমি ক্ষেত্রকর? কিন্তু ঐ পরিচয়ে তুমি স্থিত থাকতে পারবে না। একজন সামন্ত বা রাজপাদোপজীবী তোমাকে ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তুমি বণিক? তোমার ধন–সম্পদ, পণ্যসামগ্রী সমস্তই এক সুন্দর প্রভাতে দেখবে যে অপহৃত হয়ে গেছে। তুমি গৃহবধূ? তোমার রূপ–যৌবন দেখবে একদিন লম্পটের ভোগ্য হয়ে উঠেছে। বসন্তদাস উঠলো। শরীরে ক্লান্তি, মনে অবসাদ। আপাতত একটি কাজ তার এখন। আর তা হলো, মায়াবতীর অনুসন্ধান করা। হড়ডি বৃদ্ধের অনুমানটি সম্ভবত যথার্থ। পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতেই, যদি জীবিত থাকে, মায়াবতীর সন্ধান করতে হবে।
০২. পথ আর পথ
পথ আর পথ। শুধুই পথ অতিক্রমণ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করেও তার যাত্রা শেষ হলো না।
পথের আকর্ষণ অবশ্য বাল্যকাল থেকেই। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, কিন্তু কুলবৃত্তিতে তার মতি ছিলো না। গোচারণে গেলে কোনো না কোনো অঘটন ঘটাতোই সে। হয় তার গাভীটি প্রতিবেশীর ক্ষেত্র নষ্ট করেছে, নয় তার একটি গোবৎসকে সন্ধ্যাকালে পাওয়া যাচ্ছে না। পিতা হেমন্তদাস লাঠৌষধি কম প্রয়োগ করেননি–কিন্তু কাজ হয়নি তাতে। দেওয়া হলো তাকে হল চালনার কাজ, দেখা গেলো, দ্বিপ্রহর না হতেই বলীর্বদ দুটির পশ্চাৎপদগুলি রক্তাক্ত। লাঙলে তার মুষ্টি কখনই দৃঢ় হয় না। অমন কৰ্ষণকারীকে সহ্য করবে কোন গৃহস্থ? হোক না সে নিজ পুত্র!
দেখা যেতো সংসারে তার মন নেই। যখনই তার সন্ধান হতো, দেখা যেতো নদীতীরে ভাসমান নৌকাগুলির নিকটে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নৌযানের মানুষগুলির মুখে সে দূর দূর দেশের নাম শুনতো–বারাণসী, প্রয়াগ, কামরূপ, সোমদ্বীপ, বিক্রমপুর আর এইসব নাম তার কিশোর মনের কল্পনায় নানান চিত্র মুদ্রিত করে দিতো।
বণিক নতুন হলেই হলো, সে তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাবেই। বলতো, মহাশয় কি দূর দেশ থেকে আসছেন? রাজধানীতে গিয়েছিলেন কি? আপনার নৌযানে কি প্রকার পণ্য? এ স্থানে কতদিন অবস্থান করবেন? এই প্রকার সব উপর্যুপরি প্রশ্ন। কোনো বণিক বিরক্ত হতো। বলতো, কেন হে, এতো প্রশ্ন কেন তোমার? তুমি কি ভগিনী দান করবে? কোনো আসবমত্ত বনিক অশ্লীল ইঙ্গিত করতো। বলতো, বৎস, তোমার বোধ হয় পিতা নেই, তাই পিতার সন্ধান করতে এসেছো–যাও, তোমার মাতাকে আসতে বলো–তিনিই উত্তমরূপে আমার পরিচয়টি জেনে যাবেন।
কিন্তু ঐ প্রকার কর্কশ স্থূল বিদ্রুপেও বসন্তদাস নিবৃত্ত হতো না। শুধু বণিকেরা নয়, আর একটি আকর্ষণ ছিলো নদীতীরে। সে হলো কুটিরবাসী একজন যোগী। প্রায়, অষ্টপ্রহরই তিনি গীত গাইতেন। রামায়ণ–কাহিনী, ভারত–কথা, পুরাণ–বৃত্তান্ত–সমস্তই থাকতো তাঁর গীতে। ঐ প্রৌঢ় যোগীটি আবার শিক্ষাদানও করতেন। এক প্রকার উন্মাদ ছিলেন সম্ভবত। না হলে ধর্মহীন চণ্ডাল, হড্ডি, শবর ইত্যাদি নীচ জাতীয় বালকদের কেউ শিক্ষাদান করে? মৃত্তিকায় রেখা টেনে টেনে বর্ণপরিচয় হতো। কাজটি ছিলো গর্হিত। কেননা কে কবে শুনেছে যে, ডোমের পুত্র, হড়ডির পুত্র, বিদ্যাভ্যাস করে?
একদিকে বণিকদের মুখে দূর দেশের কাহিনী, অন্যদিকে উন্মাদ যোগীর কাছে বিদ্যাভ্যাস–এই দুটি আকর্ষণ ছিলো প্রবল। ঐ সঙ্গে ছিলো আবার প্রাকৃত গীতগুলি। ঐ গীতগুলি তার বড় প্রিয় ছিলো। আর সেই কাহিনী, রামের বনগমনের দৃশ্যটি–পিতা মূৰ্ছাহত, মাতা উন্মাদিনীপ্রায়, নগরবাসী হা রাম হা রাম বলে হাহাকার করছে–কিন্তু। রাম অবিচল। দৃঢ় পদক্ষেপে বনবাসে চলেছেন। কিংবা ধরো, গঙ্গা শান্তনুর বৃত্তান্তটি সত্যভঙ্গ হয়েছে বলে গঙ্গা চলে যাচ্ছেন, শিশু সন্তান কাতরস্বরে মা মা বলে ডাকছে, স্বামী মিনতি করছেন, কিন্তু দেবী গঙ্গা অবিচল। শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যেতো কিশোর বসন্তদাস। ওদিকে পিতার লাঠৌষধি প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তাতে গ্রাহ্য ছিলো না বসন্তদাসের।