মিত্ৰানন্দ হাসে। বলে, জীবনের প্রক্রিয়ায় পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হবে বন্ধু, নতুন সৃষ্টি হোক অথবা না হোক।
না, তা সম্ভব নয়, বসন্তদাস জানায়, শূন্যতায় জীবন বিধৃত থাকে না।
তাহলে কি বলতে চান, তৃতীয় কোনো শক্তির আগমন ঘটবে? যার মধ্য দিয়ে ধর্ম সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র নতুন বিন্যাসের সূচনা হবে?
বসন্তদাস সচকিত হয়, এ কোন কথা বলছে মিত্রানন্দ? তার মনে ঐ তৃতীয় শক্তির কথাটি বিদ্ধ হয়ে যায়। সে আর কিছু বলে না। মিত্রানন্দের মুখপানে চায়। লক্ষ্য করে দেখে, সেখানে দুরভিসন্ধির কোনো ছায়াপাত দেখা যায় কিনা। দেখে, কোনো ছায়া নেই মিত্রানন্দের মুখে। সহজ, স্বচ্ছ, তপশ্চর্যায় শান্ত পবিত্র একখানি মুখ। তবু অস্বস্তি বোধ হয় তার। এবং তখন সে জানতে চায়, ভিক্ষু মিত্রানন্দ, সত্য সত্যই কি তৃতীয় শক্তির কথা আপনারা চিন্তা করেছেন?
না বসন্ত, সে কথা আমি জানি না, বিশ্বাস করুন। তবে আমার মনে হয়, বর্তমান ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত না হলে জীবনের বিকাশ অসম্ভব। আমরা মানুষকে স্বপরিচয়ে উখিত হতে বলছি, নতজানু দাসত্বের জড়তা থেকে মুক্ত হতে বলছি–আমি এই পর্যন্ত জানি–এর অধিক আমার জানা নেই।
মিত্রানন্দ একখানি গোপন পত্র বহন করছে। পট্টিকেরা রাজ্যের যুবরাজ রণবঙ্কমল্লদের রচিত ঐ পত্রখানি তুলে দিতে হবে মহাভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দের হাতে। তিনি এখন কোথায় সে সংবাদটিও জানা নেই। পুন্ড্রবর্ধনে গেলে তবে জানা যাবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারে এখনও অবস্থান করছেন, না জগদ্দল মহাবিহারে প্রস্থান করেছেন। ঐ পত্রের বিষয় কী তা সে জানে না। সে বাহক মাত্র, পত্রের বিষয় তার জানবার কথা নয়। তবে এটুকু সে অনুমান করতে পারে যে রণবঙ্কমল্লদের তাঁর নিজস্ব কোনো অভিমত জানিয়েছেন। ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ যে সংবাদ অথবা প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন তারই প্রত্যুত্তরে এই অভিমত। এই অভিমত বিচার করেই ভিক্ষুসংঘ সিদ্ধান্ত নেবে। কী সিদ্ধান্ত হতে পারে তাও সে অনুমান করতে পারে না। তবে নিজে যখন ভিক্ষুসংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন অবশ্যই জানতে পাবে কী সিদ্ধান্ত হলো শেষ পর্যন্ত। সে অস্থির হয় না।
বালিগ্রামে মন্দিরদাসীদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে তা জানবার জন্য দিন দুই অপেক্ষা করে অবশেষে মিত্রানন্দের সঙ্গে বসন্তদাস যাত্রা করলো। এবার গন্তব্য পুন্ড্রনগর, সে স্থান থেকে সংবাদ নিয়ে মিত্ৰানন্দকে যেতে হবে জগদ্দল অথবা বিক্রমশীলা আর বসন্তদাস যাবে স্বগৃহে।
আর কোনো ঘটনা ঘটেনি পথিমধ্যে। বিলম্বও হয়নি। পথিমধ্যে দুই বন্ধুর আলাপ হয়েছে জগতের নানান বিষয় নিয়ে। ক্রমে বন্ধুত্ব হয়েছে গাঢ়–সম্বোধন নেমে এসেছে তুমিতে। বসন্তদাস এখন অন্য মানুষ। গৃহ ত্যাগের সময় যে বসন্তের মনে চিন্তা ছিলো কি উপায়ে সে ধনী বণিক হবে, এখন সেই বসন্তের মনে ভিন্ন চিন্তা। তার দৃষ্টি এখন মানবজীবনের লাঞ্ছনা, অপমান এবং দাসত্বের দিকে। মনে এখন জ্বালা ও বেদনা। সেই সঙ্গে আর একটি নতুন ভাব জন্ম নিয়েছে মনে। অসহায় মানুষ দেখলে সে যুগপৎ ক্রুদ্ধ। ও করুণার্দ্র হয়ে ওঠে।
অবশেষে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে, প্রায় অর্ধ-বর্ষকাল শেষে, বসন্তদাস পত্নী মায়াবতীর কাছে প্রত্যাগমন করলো।
কিন্তু আমরা জানি, বসন্তদাস যুবতী স্ত্রী মায়াবতীর বাহুডোরে বাঁধা থাকতে পারেনি। কেননা তার স্বল্পকাল পূর্বে ঘটেছিলো পিপ্পলী হাটের ঘটনা। ফলে বসন্তদাসের গৃহীর জীবনযাপন আর হলো না। ভয়ানক দুষ্কাল তাকে তাড়িত করছে–তার সাধ্য কি যে সে গৃহসুখের আস্বাদ ভোগ করবে।
০৯. পথ যে দীর্ঘ
পথ যে দীর্ঘ তা অনুমানে জানা ছিল। কিন্তু তা যে এতো দীর্ঘ কল্পনা করেনি কখনও। প্রথমে পদব্রজে, অতঃপর গো-শকটে। শেষে নৌকায়। অপরিচিত জনপদ, কেউ প্রশ্ন করে না, তোমাদের সম্পর্কটি কি? প্রশ্নের অবকাশ কোথায়? লীলা প্রায় দেহলগ্ন হয়ে বসে। অবগুণ্ঠনটি দীর্ঘ করে নববধূর মতো, আর সর্বক্ষণই প্রায় নীরব সে। চকিতে কখনও মুখখানি দেখা গেলে, কিংবা তার মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও কিছুই বোধগম্য হয় না। ফলে সকলেই সরল অনুমানটিই করে। মনে করে, নববধূ স্বামীগৃহে চলেছে।
তবে বিপদ হয়েছিলো আত্রেয়ী তীরের একটি গ্রামে। সেদিন ছিলো গ্রামের হাট। ক্ষুদ্র পান্থশালাটিতে স্থান ছিলো না। মন্দিরেও স্থান পাওয়া গেলো না। মহাসমস্যা, কোথায় রাত্রিযাপন করে। এদিকে রাত্রি গভীরতর হচ্ছে, ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্লান্তি ইত্যাদির ভারে দেহ আর চলে না। এমন সময় পান্থশালার প্রৌঢ় অধিকারীটি ডাকলেন। বললেন, আপনারা আমার গৃহে চলুন, সেখানে আপনাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হবে।
ব্যবস্থাটি অভাবিতপূর্ব, বহির্বাটির একটি সম্পূর্ণ প্রকোষ্ঠ পাওয়া গেলো–এমনকি তৈল প্রদীপটি পর্যন্ত। ফলাহারের উপকরণাদি তারা সঙ্গে বহন করে–সুতরাং আহার পর্ব সহজেই সমাধা হলো। তারপরই নিদ্রা চাই। কিন্তু শয্যা মাত্র একখানিই এবং তা এতোই ক্ষুদ্র যে একাধিক লোকের, স্বামী স্ত্রী না হলে, স্থান সংকুলান অসম্ভব। পূর্বে এমন অবস্থা হয়নি। কারণ পথিমধ্যে যে দুদিন রাত্রিযাপন করেছে সে দুদিন লীলাবতীর স্থান হয়েছে অন্তঃপুরে। বলা যায়, দুজনে এক প্রকোষ্ঠে রাত্রিযাপন এই প্রথম। শ্যামাঙ্গ কোনো প্রকার চিন্তা না করে দ্বারের কাছে ভূমিতে লম্বমান হলো। লীলাকে শয্যাখানির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো, তুমি ঐখানে শয়ন করো।