বসন্তদাস জানায়, আমি তো যুদ্ধ চাইনি, কোথায় যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কিছুই। জানি না–আমি সাধারণ মানুষ। কৃষ্ণাদেরও কি যুদ্ধ প্রয়োজন ছিলো? আমি বুঝি না ভিক্ষু মিত্ৰানন্দ, কেন এই দ্রোহ উত্থাপনের প্রস্তাবনা, এতে তো মৃত্যু এবং ধ্বংস ব্যতীত অন্য কিছুই আমি দেখছি না।
মিত্রানন্দের সন্দেহ হয়, তবে কি এই লোকটি তাদের কাজের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন, কোনো সংবাদই জানে না? তাহলে দিবানাথের গৃহেই বা তার আশ্রয় কেন হলো? সে নিশ্চিত হতে পারে না।
তথাপি সে বলে, বসন্তদাস, আমি জানি না, আপনি কী চিন্তা করেন। কিন্তু নিজের জীবনের কথা কখনও ভেবেছেন? আপনার, আপনার পিতার, আপনার পিতামহের? মনে হয় না কি আপনি পুরুষানুক্রমে দাস? সামন্তপতির দাস, কায়স্থের দাস? আপনার কি ভগবান আছে? আপনি ভগবানের পূজা করতে পারেন? চণ্ডালদের কথা চিন্তা করুন, ডোম হড়ডিদের কথা চিন্তা করুন। নিমশূদ্রে কত বর্ণ ভেবে দেখেছেন? শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ, একে অপরের ওপর লাঞ্ছনা করে, শোষণ করে, লুণ্ঠন করে। আপনি কি লুণ্ঠিত হননি, বলুন? সামন্তপতি যে আপনার সমস্ত কিছু অপহরণ করলো, তার প্রতিকার কোথায়?
মিত্রানন্দের কথায় বসন্তদাসের প্রত্যয় হয় না। তার মনে হয় না যে এতো সরলভাবে প্রশ্নগুলি করা যায়। সে বলে, এভাবে প্রশ্ন করলে তো সমাধান পাওয়া যাবে না। রাজপুরুষ অত্যাচারী হলে রাজার কাছে যেতে হবে–সে জন্য দ্রোহের প্রয়োজন নেই। আর শ্রেণীর কথা বলেছেন, ব্রাহ্মণ শূদ্র এক হতে পারে কখনও? ভগবান যদি কারও জন্য শূদ্র জন্ম নির্দিষ্ট করে থাকেন, তাহলে শূদ্রের কাজই তার কর্তব্য। সে কেন ব্রাহ্মণের কাজ করতে যাবে? সকলেই কি রাজা হয়? যার সৌভাগ্য ভগবান নির্দিষ্ট করে দেন সে–ই রাজা হয়। মনে করুন, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ও সেইরূপ।
আপনি যুক্তির কথা বলুন–আপনি তো দেখছি বিশ্বাসের কথা বলছেন?
না যুক্তি আমারও আছে, বসন্তদাস জানায়। বলে, সকার্য যে করে, সৎ জীবন যে যাপন করে, জ্ঞানালোচনা করে, যে মানুষকে পথ নির্দেশ করে, সে মানুষকে আমি শ্রেষ্ঠ বলবো না? ব্রাহ্মণ তো সেই বিচারেই শ্রেষ্ঠ। নীচ–স্বভাব যে, হীন যে, যার মুখে সর্বদা মিথ্যা ভাষণ, যে তস্কর–সেই লোক এবং ব্রাহ্মণ এক হওয়া কখনই সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, আমারও সেই কথা, মিত্রানন্দ স্বীকার করে। বলে, শ্রেষ্ঠমানব তার গুণে, জন্মে নয়, কুলক্রমে নয়। যদি কোনো ব্রাহ্মণ লুণ্ঠন করে, হত্যা করে, আপাদমস্তক যে লম্পট, তাকে আমি ব্রাহ্মণ কেন বলতে যাবো? বাস্তবে আমরা কী দেখি, বলুন? সকল ব্রাহ্মণ কি ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করে? ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য প্রজা পালন, সে কি প্রজা পালন করে? আবার দেখুন, আপনি পুরুষানুক্রমে সৎ জীবনযাপন করলেও ব্রাহ্মণ হতে পারবেন না।
বসন্তদাস তথাপি সংশয়মুক্ত হতে পারে না। বলে, মিত্রানন্দ শ্রেণীভেদের এ বিধান সনাতন–হঠাৎ পরিবর্তন করতে চাইলেই পরিবর্তন হবে না। সদ্ধর্মী বৌদ্ধরাও ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ ভেদ লুপ্ত করতে পারেনি।
এই প্রশ্নে সদ্ধর্মীরা দুর্বল, মিত্রানন্দ জানে। তাই সে ব্রাহ্মণব্রাহ্মণ প্রশ্নে ভগবান তথাগতের কথা স্মরণ করে। তার বিশ্বাস, ব্রাহ্মণব্রাহ্মণে যে ভেদ করে, সে প্রকৃত সদ্ধর্মী নয়। সেই একই কথা সে বসন্তদাসকে জানালো, বললো, মানুষের অপমান যদি কোনো সদ্ধর্মী কখনও সমর্থন করে, তাহলে বুঝবেন, সে সদ্ধর্মী নয়।
সে না হয় হলো, বসন্তদাস এবার সহজ হয়। বলে, ধরে নিলাম দ্রোহের পতাকা উত্থাপিত হলো, রাজাও হলো নতুন–কিন্তু তারপর? ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদির আধিপত্য না থাকলেও অন্য কোনো শ্রেণীর আধিপত্য যে থাকবে না–তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? তথাগত ধর্ম তো সর্বত্রই ছিলো একদা–সেইকালে কি সামন্ত মহাসামন্তদের দৌরাত্ম ছিলো না? চণ্ডাল ডোমেরা কি তখনও নিগৃহীত হয়নি? বলুন আপনি?
মিত্রানন্দ কিন্তু নিজ বিশ্বাসে অবিচল। সে হাসে। বলে, প্রশ্নটা ধর্মীয়, যৌক্তিকতার নয় বসন্তদাস, প্রশ্নটা হলো মানব মুক্তির, মানব মুক্তির পথে যা অন্তরায় তা–ই অধর্ম এবং পরিত্যাজ্য–আমাদের এই দৃষ্টিতে সমগ্র বিষয়টি বিচার করে দেখতে হবে।
বসন্তদাস বিভ্রান্ত বোধ করে। বলে, আপনি যা বলছেন তা আমার ধারণায় আসে। মুক্তি কথাটি তো বিপজ্জনক–কোন বন্ধন থেকে মুক্তি সেটার নিশ্চয়ই উল্লেখ থাকতে হবে। অর্থাৎ একটি বিধিমালা আপনার থাকতে হবে–তার অর্থ আর একখানি অর্থশাস্ত্র। মানব মুক্তি তো বায়বীয় ব্যাপার হয়ে থাকলে চলবে না। এবং তখনই আপনার কার্যক্রমের ভিত্তিটি লোকে পেতে চাইবে–সেখানেই আসে ধর্ম এবং শাস্ত্র। বলতে হবে, আপনার ধর্ম কি প্রকার–বলতে হবে, সমাজ কি প্রকার বলতে হবে, ধন ব্যবস্থা কি প্রকার–মিত্রানন্দ, তাই বলছিলাম, যত সরল ও সহজভাবে আমরা প্রশ্নগুলি তুলছি–এগুলি এত সহজ ও সরল নয়।
আপনি কি তাহলে বিশ্বাস করেন, যে ব্যবস্থা এখন প্রচলিত, তাতেই মানুষ সুখী হবে? তাতেই জীবনের বিকাশ ধারা প্রবাহিত হবে? মিত্রানন্দ এবার স্পষ্ট উত্তর চায়।
না, আমি প্রচলিত ব্যবস্থায় তুষ্ট নই, বসন্তদাস জানায়। বলে, আমি জানি এই ব্যবস্থা আমার ধনার্জনের পথ উন্মুক্ত রাখেনি, আমাকে বিদ্যার্জন করতে দেয়নি–এমনকি, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষও যে নিরুপদ্রব সংসার জীবনযাপন করবে, তারও কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি–আমি প্রচলিত ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ ও বিধ্বস্ত করতে চাই কিন্তু এও আমি জানতে চাই যে, পরিবর্তে আমি কী পাবো।