অতি প্রত্যুষে বনকুকুটের ডাক আরম্ভ হতেই সে আর স্থির থাকতে পারলো না। হডিপল্লীর ঘাটে বাঁধা ক্ষুদ্র কোষা নৌকাখানি নিয়ে সে নদী অতিক্রম করে পূর্বতীরে উপনীত হলো।
নদীতীর একেবারেই নিঃশব্দ। কেবল ঊষাকালের শীতল বায়ুতাড়নায় বৃক্ষরাজির পত্রপল্লবে মর্মরধ্বনি উঠছে। ঐ তো বট এবং অশ্বত্থ বৃক্ষগুলি, বৃক্ষতলের উচ্চবেদীসমূহ। ঐ সকল বেদীতে কতদিন অপরাহ্নে সে বিশ্রাম নিয়েছে। বটবৃক্ষের সংখ্যাধিক্যের কারণেই কি গ্রামখানির নাম উজুবট? বটবৃক্ষ কি ঋজু হয়? সে একবার নামটির তাৎপর্য ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলো, সফল হয়নি। গ্রাম বৃদ্ধেরাও কেউ তাকে ঐ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেনি। আহা মাত্র সেদিনই না সে এই নদীতীরে ভ্রমণ করেছে! বালক ও কিশোরদের খেলার সঙ্গী হয়েছে! কি নাম ছিলো যেন বালকটির? অর্কাস? হ্যাঁ, ভারী সুন্দর নামটি আর মুখখানি কেমন ভারী কোমল, আর এতো মায়া চক্ষু দুটিতে যে দৃষ্টিপাত হলে সে দৃষ্টিকে আর সরানো যেতো না। সেই অর্কাস এখন কোথায়? এবং সেই বৃষস্কন্ধ বলশালী কিশোরটি? প্রতিটি কথায় যার হাসি উচ্ছ্বসিত হতো?
নদীতীরে নৌকা নেই কেন? এখানে না বীথির পর বীথি নৌকা ভাসমান থাকতো! তার মনে পড়ে, পল্লীটি কোলাহলে মুখর হয়ে জেগে উঠতো প্রত্যুষকালে। গোধনের হাম্বা রব, ক্ষেত্রকরদের সচিৎকার আহ্বান, ধার্মিক প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের কণ্ঠে শিবের মঙ্গলগীতি, সমস্ত একত্রে পল্লীটির প্রাণ–চাঞ্চল্য প্রকাশ করতো। এখন একেবারেই নিঃশব্দ। ভ্রম হয়, যেন কোনো শোনে এসে উপস্থিত হয়েছে।
এখানে ভস্মস্তূপ, ওখানে অর্ধদগ্ধ কুটির চালা, চারিদিকে ভগ্ন তৈজসাদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কোনো এক গৃহবধূর হাতে সীবনকৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কন্থার প্রান্তদেশে বৃক্ষশাখার তোতাপাখিটি বড় মনোহর। সে হাতে তুলে নিতে গিয়েও নিলো না। অনুমান করতে চেষ্টা করলো, কার গৃহ ছিলো এ স্থানে? দেখলো, বৃথা চেষ্টা। কিছুই অনুমান করা যায় না। সমস্ত কিছু একাকার। উকট একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। ক্রমে দুর্গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠলো। ঐ সময় সে একটি পথকুক্কুর দেখলো। তার স্ফীতোদরটি দেখবার মতো। এবং আরও দেখলো, অনতিদূরে একটি শিশুর ছিন্নবাহু নিয়ে দুটি শ্মশান শৃগাল কলহ করছে। শৃগাল ও কুকুরের যে সহাবস্থান হতে পারে, তার জানা ছিলো না।
বসন্তদাস অধিকদূর অগ্রসর হতে পারলো না। দূরে ব্রাহ্মণপল্লীর মন্দিরে ঐ সময় ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সে ঘণ্টাধ্বনিটি শুনলো অনেকক্ষণ ধরে। কল্যাণ ও মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা আরম্ভ হয়েছে। শ্লোকটি তার মনে পড়লো, যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি …. ধর্মে যখন গ্লানির অনুপ্রবেশ ঘটে, জগত পাপে পূর্ণ হয়ে যায়, দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির নিমিত্ত এবং সাধু ব্যক্তিদের পরিত্রাণের জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। বড় আশ্বাসের কথা। ধর্মে এবং জীবনে মানুষকে সুস্থির করার জন্য এতদপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ আশ্বাস আর কী হতে পারে।
ভগবান বিষ্ণুর অধিষ্ঠান কোথায়? তার মনে প্রশ্ন জাগে। যেখানে এবং যাদের মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান, সেখানে কি গ্লানি আছে? নির্যাতিত মানব শিশুর রোদন ধ্বনি কি অতদূরে কারও শ্রবণ স্পর্শ করে? কে জানে, বসন্তদাসের অন্তত জানা নেই। ভগবান বিষ্ণু, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, নৃসিংহ ইত্যাদি সকল রূপেই মর্তে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু চণ্ডালের, কি ব্রাত্য শূদ্রের গৃহে কখনও কি তাঁর জন্ম হয়েছে? কেন হয়নি, বলা কঠিন। তবে হলে বড় ভালো হতো। চণ্ডাল ডোম হড়ডিরা ভাবতে পারতো যে নর সত্য সত্যই নারায়ণ। এই চিন্তা করে সুস্থ ও সাহসী হতে পারতো যে তারাও একই ভগবানের আশ্রিত।
পুরাণ-কথার সঙ্গে সঙ্গে তার জাতক–কাহিনীও মনে পড়লো। কিন্তু সবই বিচ্ছিন্ন, সংলগ্নতাবিহীন ও পারম্পর্যশূন্য–ক্ষণে ক্ষণেক আলোকোদ্ভাসের মতো। সে জানে, এমন তুলনা একেবারেই অনর্থক–কেউ এমন তুলনা কখনও করবে না। ন্যায় এবং মীমাংসার পদ্ধতিগুলিও তার জানা নেই। আর জানা থাকলেই বা লাভ কি? তার কি সাধ্য যে পুরাণ ও জাতক কাহিনীর তুলনামূলক বিচার করবে? বিশেষত এই সময়ে? সুতরাং চারিদিকে যা ঘটছে তা স্বীকার করে নাও। তোমার মানবজন্মের এই-ই ললাট লিপি।
সে আরেকবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে। এখন তার চারিদিকে ধ্বংস ও মৃত্যু। নরক কি এই প্রকার? হতে পারে–তার অনুমান হয়। জীবনহীনতা এবং সম্ভাবনাহীনতা একত্রিত হওয়ার নামই সম্ভবত নরক। বিকৃতি, পচন, পাপ, পতন–এ সমস্তই নরকের লক্ষণ। আর সমস্তই সম্ভব হয় জীবনের অনন্ত প্রবাহটি স্তব্ধ হয়ে গেলে। সৃজন ও জীবনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেই নরকের আরম্ভ। সে যেখানে দাঁড়িয়ে তা এখন নরকই, অন্য কিছু নয়। এবং একইসঙ্গে বাইরের যে জগৎ বিস্তৃত, যেখানে পিপ্পলী হাটের মতো ঘটনা ঘটে, সে স্থানও নরক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তার মনে হয় না দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য আছে।
বিধ্বস্ত পল্লীটির বুকে দাঁড়িয়ে বসন্তদাস কেবলই উদভ্রান্ত হচ্ছিলো। নানান কথা আসছিলো মনে। বেদনা-শোক-ক্ষোভ-ক্রোধ ইত্যাকার অনুভূতিগুলি তখন আর সজাগ ছিলো না। যেন বিচিত্র এবং প্রকাণ্ড শূন্যতার মধ্যে সে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে, তার কিছুই করণীয় নেই। কোনো কিছুর সঙ্গেই সে আর সম্পর্কিত নয়।