সে আর এক কাহিনী–যে কাহিনী তাকে মিত্রানন্দের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে, বলা যায়, তার জন্মান্তর হয়েছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস, তুমি কি এমন ছিলে?
০৮. দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটি
দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটিকে সমাধিস্থ করে বসন্তদাস যে স্বর্ণ ও মণিখণ্ডগুলি পায়, সেগুলি ক্রমে তার কাছে হয়ে ওঠে দুর্ভার। সে জানতে, ঐ সকল মণিমাণিক্য যদি বিক্রয় করতে হয়, তাহলে পুন্ড্রনগরীতে যেতে হবে। সেই চিন্তাক্রমে সে যাত্রাও করেছিলো পুন্ড্রনগরী অভিমুখে। সেই সঙ্গে আবার পথিমধ্যে ধনী বণিকের সন্ধানেও ছিলো তৎপর। তবে সমস্তই সাবধানে। নিজের কাছে যে মূল্যবান কিছু আছে, তা সে কখনই প্রকাশ হতে দেয়নি।
পথিমধ্যেই সাক্ষাৎ হয় এক বৃদ্ধ সুবর্ণবণিকের সঙ্গে। বণিকটি বৃদ্ধ এবং সজ্জন। তিনি বসন্তদাসকে নিজ গৃহে নিয়ে যান। সেখানে বসন্তদাস একটি হীরকখণ্ড বৃদ্ধকে দেখায়। জানতে চায়, এর প্রকৃত মূল্য কত হতে পারে, বলবেন?
বৃদ্ধ প্রথমত বিমূঢ় হয়ে যান। পরে হীরকখণ্ডটি হাতে নিয়ে মনোযোগসহকারে পরীক্ষা করে বলেন, মহাশয় যদি বিক্রয় করতে চান, তাহলে আমি দুইটি পর্যন্ত দীনার দিতে পারি।
ঐ কথা শুনে বসন্তদাস প্রমাদ গণনা করে। কী কাণ্ড দেখো, যেটি ক্ষুদ্রতম, তারই মূল্য দুই দীনার! এখন তার নিকট মণিমাণিক্য আছে, এই সংবাদটি প্রচারিত হলেই হয়েছে। আর দেখতে হবে না, দস্যুহস্তে মৃত্যু একেবারে অবধারিত। সে জানায়, মহাশয়, এই মণিটি আমি আপনার কাছে বিক্রয় করছি–কিন্তু এই ক্রয়–বিক্রয়ের কথাটি আপনাকে গোপন রাখতে হবে, আমি এইরূপ আরও কয়েকটি মণি আপনার কাছে বিক্রয়ের আশা রাখি।
বয়সে বৃদ্ধ হলেও বণিকটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মণিমাণিক্যাদি যেমন চেনেন, তেমনি চেনেন মানুষকেও। বসন্তদাসকে বললেন, মহাশয়, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে আমি যে মূল্য দিয়েছি সেটি প্রচার করলে বিপদ কি শুধু আপনার? আমার নয়? আপনি নিশ্চিন্তে অন্য হীরকগুলি নিয়ে আসবেন–সমস্তই আমি ক্রয় করবো।
বসন্তদাসের একেকবার লোভ হচ্ছিলো হীরকগুলি বাহির করে। কিন্তু আবার ভয়ও হচ্ছিলো। সে নিজেকে সংযত রাখলো। এবং জানতে চাইলো, মহাশয়, যদি এমন হয় যে পুন্ড্রনগরীর বণিকেরা অধিক মূল্য দিতে চাইলো, তখন কি হবে?
বৃদ্ধ হাসলেন। বললেন, মহাশয়ের বোধ হয় সন্দেহ হচ্ছে যে কম মূল্য পেয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধের একটি কথা মনে রাখবেন, ভুলেও যেন মণিমাণিক্যাদি নিয়ে পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। গেলে সর্বনাশ হবে, তারা দস্যু লুণ্ঠকদের পোষকতা করে। আপনি আমার কাছে না আসুন, অন্যত্র যান, কিন্তু কখনই ঐ পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। প্রকৃত ধনী বণিকেরা কি এখন আর প্রকাশ্যে বণিকবৃত্তি করতে পারে? দেখছেন না, স্বর্ণ বণিকেরা কীভাবে রাজপুরুষদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। এখন প্রকৃত বণিক নেই–যারা আছে, তারা প্রতারক, নয়তো লুণ্ঠক।
বৃদ্ধের কথা যে অমূলক নয় তা বসন্তদাস অপেক্ষা অধিক আর কে জানে। সে কৌতূহলী হলো। বললো, আমি না হয় বণিকদের কাছে গেলাম না, কিন্তু আপনি ঐ মণিমাণিক্যাদি নিয়ে কি করবেন? নিশ্চয়ই আপনাকে বিক্রয় করতে হবে।
বৃদ্ধ ঐ কথা প্রসঙ্গেই সেদিন ফল্পগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণের সংবাদ জানান। দশ ক্রোশ উত্তর–পূর্বে গেলে ফল্পগ্রামে উপনীত হওয়া যাবে। ঐ ফরুগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণ বিলাসী, ব্যসনপ্রিয় এবং ধনী। মণিমাণিক্য সংগ্রহের উৎসাহ তাঁর প্রবল।
নামের সঙ্গে গ্রাম শব্দটি যুক্ত থাকলে কি হবে, ফল্পগ্রাম সমৃদ্ধ জনপদ। এই জনপদে ক্ষুদ্র একটি জয়স্কন্ধাবার বর্তমান। নিকটবর্তী সমৃদ্ধতর জনপদ বালিগ্রাম, সে স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। বসন্তদাস ফরুগ্রামে উপনীত হয়ে নিজের বণিক পরিচয়টিই প্রচারিত করে।
শ্রীনাথবর্মণের সম্মুখীন হয়ে বসন্তদাস প্রণাম জানিয়ে বলে, মহারাজ, আমি দূর দেশ থেকে এসেছি, আপনার খ্যাতি ও মহিমা বহুদূর বিস্তৃত–তদুপরি আপনার সৌন্দর্য বোধ ও সুরুচির পরিচয় লোকের মুখে মুখে প্রচারিত–আমি সেই কারণেই সামান্য কিছু সামগ্রী নিয়ে এসেছি–আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করলে আমি নিজের বণিকজীবন সার্থক মনে করবো।
শ্রীনাথবর্মণ প্রথমে বস্ত্র দুখানি দেখলেন। দেখে বললেন, তুমি দেখছি প্রকৃতই রুচিবান লোক হে, বস্ত্ৰ দুখানি তুমি আমাকে দিতে পারো।
গন্ধাসবের আধার দুটি শ্রীনাথবর্মণের হাতে দেওয়া হলে তিনি একেবারে উল্লসিত হয়ে উঠেন। বলেন, অহহ! কী সুগন্ধ! পারিজাত পুষ্পের সুগন্ধ কি এই প্রকার হয়? তুমি যে আমাকে অত্যাশ্চর্য বস্তু দেখালে হে!
অতঃপর একটি হীরকখণ্ড তার সম্মুখে রাখলো বসন্তদাস। হীরকখণ্ডটি অত্যধিক দ্যুতিময়। নিজ হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন সামন্তপতি। মনে হলো, চিন্তা করলেন কিছু। তারপর জানতে চাইলেন, আর কি আছে তোমার দেখি?
প্রভু যা দেখছেন, এই-ই আমার সম্বল, অধিক কোথায় পাবো–ক্ষুদ্র বণিক আমি এসব পণ্যের কিরূপ মূল্য তাতে আপনার অবিদিত নয়।
হুঁ, শ্রীনাথবর্মণ অর্ধশায়িত অবস্থা থেকে দেহটিকে সামান্য তুললেন। বললেন, বাকপটুতাতে দেখছি কম যাও না। কিন্তু ঐ বাকপটুতা অন্যত্র প্রদর্শন করো–এখন যা আছে, বাহির করো, আমি দেখবো।