শয্যায় আসন নিয়েছিলো ছায়াবতী। সে ডাকলো, এখানে এসো, পাশে বসো আর অনুগ্রহ করে গ্রাম্য ষণ্ডের মতো গাঁক গাঁক করে চিৎকার করো না, মৃদু স্বরে কথা বলল।
বসন্তদাসের ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। ছায়াবতী তার ইতস্তত ভাব দেখে তিরস্কার করে। বলে, তুমি যে দেখছি অনভ্যস্ত বালকের মতো আড়ষ্ট হয়ে রইলে। ভয় পেয়ো না হে সাধুপুরুষ, তোমার সংযমের প্রাচীর ভঙ্গ করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই–আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত–আর এ বাসকসজ্জাও তোমার জন্য নয়। এটি ইতোমধ্যেই উচ্ছিষ্ট হয়ে রয়েছে। তুমি অতিথি, দেবতাতুল্য, উচ্ছিষ্ট দিয়ে তোমার পূজা করবো, এ কি হয়?
শোনো, বসন্তদাস পার্শ্বে উপবেশন করলে ছায়াবতী পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, সংবাদ পেয়েছি, তোমার আত্মীয়রা সুনন্দগ্রামে অবস্থান করছেন। বৃদ্ধ শুকদেব, তাঁর স্ত্রী ও কন্যা এবং অপর একজন প্রৌঢ় একত্রে আছেন। আশ্রয়দাতা এক ক্ষেত্রকর গৃহস্থ। প্রত্যেকেই সুস্থ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওদিকে উজুবটের অবস্থা এখন শান্ত, হরিসেন এখন রাজধানীতে। তবে মনে করো না যে তুমি নিরাপদ। তোমার নাম গূঢ় পুরুষেরা জানে। তোমাকে যদি পায়, তাহলে অবশ্যই বন্দী করবে। তোমার ঐ স্থানে গমন নিষিদ্ধ।
বিস্ময়ে বসন্তদাসের বিমূঢ়াবস্থা হয়–এ নারী কি দৈবজ্ঞ নাকি। এতো সংবাদ সে কীভাবে সংগ্রহ করলো? একেবারে মায়াবতীর পিতার নাম পর্যন্ত বলে দিচ্ছে। সে বললো, ভদ্রে, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো জানি না–আপনি আমাকে স্বস্থ ও নিশ্চিন্ত করলেন, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
ভগবান ইতোমধ্যে আমার প্রচুর মঙ্গল করেছেন, ছায়াবতী হাসে। বলে, এতো মঙ্গল করেছেন যে তা রাখবার মতো আমার স্থান নেই–এখন তুমি আমাকে কিছু সংবাদ দাও দেখি, বলল, যবনেরা কি সত্য সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন করছে?
কেন, আপনি কি যবনদের ত্রাতা এবং দয়ালু জ্ঞান করেন?
না, তা নয়, ছায়াবতী বলে, আক্রমণকারী বহিরাগত সৈন্যদলের আচরণ সর্বত্রই এবং সর্বদাই একরূপ হওয়ার কথা, এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু কেউ কেউ যে বলছিলেন, যবন জাতি এলে প্রকৃতিপুঞ্জ রক্ষা পাবে, সামন্তপতিদের অত্যাচার দূর হবে, রাজানুচরদের প্রতাপ দমিত থাকবে–সেই জন্যই কিঞ্চিৎ আশা হচ্ছিলো, হয়তো বা এই যবন জাতির আচরণ অন্যরূপ হবে–এখন দেখছি, আমার পূর্বধারণাই সত্য, আমি যাই।
ছায়াবতী উঠে দাঁড়ালে বসন্তদাস বললো, আমার একটি কৌতূহল আছে।
বলো।
আপনি কেন এই গোপনতা অবলম্বন করেছেন–প্রকাশ্যে কি এসব কথা বলা যেতো না?
না হে নাগর, তা বলা যেতো না, হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে বেপথু হয় ছায়াবতী। বলে, প্রণয় ভাষণ কি প্রকাশ্যে সম্ভব? না তাতে আনন্দ আছে? আমি যে তোমার প্রণয় প্রার্থিনী হে, তা কি বোঝোনি?
হাসির উচ্ছ্বাস দমন করে যখন স্বাভাবিক হলো ছায়াবতী তখন সে আবার অন্য রমণী। বললো, বসন্তদাস, একটা কাজ করে দেবে?
বলুন, কী কাজ?
পুন্ড্রনগরীর একটি সংবাদ চাই। নিরঞ্জন আমার ভ্রাতা, বাল্যকাল থেকে নিরুদ্দেশ শুনেছি, সে সদ্ধর্মীদের সঙ্গে থাকে এবং প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছে, যদি পারো, সংবাদটি আমাকে এনে দিও।
ছায়াবতীর কথা শুনে বসন্তদাসের মনে একইসঙ্গে নানান প্রশ্নের উদয় হয়। মন্দিরদাসীরও তাহলে ভ্রাতা থাকে, এবং সেই ভ্রাতার জন্য আবার উৎকণ্ঠাও থাকে? ওমন তো কখনও শোনেনি সে। উপরন্তু সংবাদ সংগ্রহের জন্য সে কি উপযুক্ত ব্যক্তি?
বললো, আপনি নিজেই তো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন–আপনার মতো কি আমি পারবো?
ছায়াবতী নীরব থাকে কয়েকমুহূর্ত। তারপর বলে, তার সংবাদ তো আমি পেয়েছি কিন্তু সে আমার সংবাদ পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।
বসন্তদাস স্বীকৃতি দান করে। বলে, যদি আমি তার সাক্ষাৎ পাই, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনার কথা বলবো।
ছায়াবতী আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর বলে, আমি যাই এবার, রাত্রি হয়েছে।
আর হ্যাঁ, শোনো, ছায়াবতী পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, কাল প্রভাতে যখন পূজারম্ভে লোকসমাগম হবে, তখন মন্দির ত্যাগ করো, পূর্বে বা পরে নয়। আমার দুই প্রেমিক প্রায় সর্বক্ষণই মন্দিরের উপর দৃষ্টি রাখে।
ছায়াবতী অন্ধকারে ছায়ার মতোই অদৃশ্য হলো। বসন্তদাস দ্বারের বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার অবাক লাগছিল, অদ্ভুত রহস্যময়ী এই নারী। কেন যে অমন কৌতুক করে, বোধগম্য হয় না। তবে অস্পষ্ট অনুমান হয়, তার জীবনে কোথাও একটি গভীর বেদনা রয়েছে। সে যখন হাসে, তখন মনে হয়, সে হাসি কান্নারও অধিক। আর কি মমতাময়ী! বসন্তদাস তার কেউ নয়, অথচ তার নিরাপত্তার জন্য কতই না চিন্তিত। সে ছায়াবতীর উদ্দেশে মনে মনে প্রণতি জানালো।
কৃষ্ণার কথা মনে পড়লো ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেও এক মন্দিরদাসী, মাত্র এক রজনীর জন্য এসেছিলো তার জীবনে। কিন্তু ঐ একটি রজনী দুরপনেয়ভাবে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে তার স্মৃতিতে। কৃষ্ণার সঙ্গে কি আর কোনোদিন দেখা হবে না? তাকে। কি প্রাণ দিতে হয়েছে শেষাবধি? সে জানে না, প্রকৃত সংবাদ কেউ দিতে পারেনি। মিত্রানন্দকে সে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে–যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হলো উজুবটে, সেদিনও। কিন্তু না, মিত্রানন্দ কোনো সংবাদই জানে না।