হলায়ুধ মিশ্র উঠলেন। অহেতুক অনেক বিলম্ব হয়েছে। এই প্রকার প্রলাপ শুনতে হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। তবু বললেন, বন্ধু সোমজিৎ, রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করে তুমি অহেতুক মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করছো, ওতে কোনো ফল হবে না। আর জেনো, ব্যক্তির ইচ্ছায় কিছুই হয় না–সমস্তই হয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। আর এও জেনো, কর্মফল থাকবেই–দাসও থাকবে, প্রভুও থাকবে। প্রভু যে শাসন করে, সে যেমন কর্মফল, দাস যে শাসিত হয়, সেও তেমনি কর্মফল। যবনদের আগমনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বা কী করবে–যা ভবিতব্য তাই হবে। এও কর্মফল বলতে পারো। আমার বিশ্বাস, যবনদের আগমনে ধর্ম বলো, জাতি বলো, সমাজ বলল, কোনো কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা যদি এদেশ জয় করে নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের এদেশ শাসন করতে হবে। সামন্ত বলো, মন্ত্রী বলো, সেনাপতি বলো, এমনকি গ্রামপতি বীথিপতি বলো–এদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে কি রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব? সুতরাং অহেতুক তোমার দুশ্চিন্তা। যবনরা যদি আসে, তখনও দেখবে তাদের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা সদ্ভাব করছে আমাদের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে। নীচ যে, সে সর্ব অবস্থায় নীচই থাকবে।
সোমজিৎ উঠলেন। হলায়ুধ মিশ্রের কথা শুনে ক্ষীণ হাসি ফুটলো তার মুখে। বললেন, মনে হচ্ছে যবনদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করার জন্য রাজধানীর লোকেরা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে?
হলায়ুধ স্থির করেছেন পুরাতন বন্ধুর উপর কুপিত হবেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন, বিদ্রূপ করো না সোমজিৎ। যবনেরা কীরূপ শক্তি ধরে তা কি জানো? দৈহিক, শাস্ত্রিক, আধ্যাত্মিক সকল বলেই তারা অধিকতর পারঙ্গম। একটি যবন সাধুপুরুষকে দেখলাম, একটি মৃত বালককে মন্ত্রবলে জীবিত করে দিলো। তুমি কল্পনা করতে পারো, তিনটি বন্য ব্যাঘ নিমেষে বশীভূত হয়ে গেলো ঐ সাধুপুরুষটির সামান্য একটি ইঙ্গিতে। এদিকে রাজ জ্যোতিষীরা গণনা করে যা দেখেছেন, তাতে মঙ্গল কিছুই দেখা যাচ্ছে না মহারাজের জন্য। এমতাবস্থায় যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস, ওতেই কাজ হবে।
সোমজিৎ বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে হলায়ুধের কথা শুনছিলেন। তাঁর বিশ্বাস হতে চাইছিলো না যে ঐ প্রকার কথা বলতে পারে হলায়ুধ মিশ্রের মতো লোক। তিনি ভেবেছিলেন, জিজ্ঞাসা করবেন, ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থখানির রচনা সমাপ্ত হয়েছে কি না–আর সেই আখ্যান গ্রন্থখানির কি হলো, যেখানি তিনি গত বৎসর আরম্ভ করেছিলেন। আরও জানার ইচ্ছা ছিলো, বল্লাল রচিত অদ্ভুত সাগর গ্রন্থখানি মহারাজ সমাপ্ত করছেন বলে তিনি শুনেছিলেন, গ্রন্থখানির রচনা কি সমাপ্ত হয়েছে? কিন্তু হলায়ুধের কথা শুনে ঐ সকল প্রসঙ্গ আর তুললেন না। তাঁর প্রবৃত্তি হলো না। তার তখন মনে হচ্ছে, গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেন দেবের মহামন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কী ঘটবে, তা যেন সমস্তই জানা হয়ে গেছে সবার–এবং সেই সঙ্গে কার কি করণীয় তা–ও যেন স্থির করে রেখেছে প্রত্যেকে।
সোমজিৎ ক্লান্তপদে চতুষ্পঠী থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। কেশবাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, পিতঃ আপনি পদব্রজে যাবেন?
তিনি কিছুই বললেন না জামাতার প্রশ্নের উত্তরে।
সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। রাজপথে এখন বহু লোক। বিপণীগুলিতে তৈলদীপ জ্বালানো হচ্ছে। দূরে কোনো এক মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেলো। সোমজিৎ ক্লান্ত পদক্ষেপে ধীরগতিতে পথক্রমণ করছিলেন। একটি ভবনের সম্মুখ দিয়ে যাবার সময় দেখলেন ভবনটির সম্মুখে ক্ষুদ্র একটি জনসমাবেশ। একটি লোককে পরিচিত মনে হলো। মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছেন। লোকটি নিকটে এসে প্রণাম করলে চিনলেন–সামন্ত হরিসেনের অনুচর উল্লাসদত্ত। বললেন, তুমি এখানে?
হ্যাঁ মহাশয়, উল্লাস জানায়, আমাদের প্রভু রাজধানীতে এসেছেন।
সোমজিৎ দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করে বলেন, তিনি কোথায়?
লোকটি ইতস্তত করে ক্ষণেক। শেষে বলে, উনি ঐ ভবনে এসেছেন। আপনি কি সাক্ষাৎ করবেন?
কে থাকে ওখানে, কার ভবন ওটি?
লোকটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, আপনার যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে বলুন।
সোমজিৎ বুঝলেন, হরিসেন কোথায় এসেছে সেই সংবাদটি তাঁর অনুচর গোপন রাখতে চায়। বললেন, সংবাদ গোপন রেখে কি হবে, আমি মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, তোমার প্রভুকে বলে দিও, তার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তিনি যা। করছেন, তা-ই এখন করণীয় সকলের।
লোকটি প্রায় বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখে সোমজিৎকে। তারপর জানায়, না মহাশয়, আপনি যা ভাবছেন তা নয়–ঐ ভবনে কোনো রাজপুরুষ থাকেন না, ওটি নগর নটিনী বিদ্যুপ্রভার ভবন। আপনি কি অভ্যন্তরে যাবেন?
সোমজিৎ কী বলবেন ভেবে পান না। লোকটির কি হ্রস্ব দীর্ঘ কোনো জ্ঞানই নেই? বললেন, না বৎস, আমি বৃদ্ধ লোক, দেখতেই পাচ্ছো
তাতে কি? লোকটি সলজ্জ হাসি হেসে জানায়, এখানে বহু বৃদ্ধ রাজপুরুষ আসেন। বিদ্যুত্বভার নৃত্য দেখলে জীবনে ভুলতে পারবেন না।
সোমজিৎ আর বাক্য ব্যয় করলেন না। না, আর কিছু জানবার বা বুঝবার নেই। লোকমুখে এবং জনরবে যা শুনেছিলেন, সবই সত্য। সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ব্যস্ত আনন্দ আর ব্যসনে। রাজকর্ম কী, প্রজাপালন কী, যুদ্ধবিগ্রহ কী,এ সকল বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। উত্তম লক্ষ্মণাবতী, তিনি মনে মনে বললেন, উত্তম রাজ চক্রবর্তী পরম ভট্টারক ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়কুলতিলক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব, সমস্তই উত্তম, কারোই কিছু করণীয় নেই–না তোমার, না তোমার অনুচরদের। ভবিতব্য তোমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা–ই ঘটবে, বৃথাই আমরা চিন্তা করে মরি।
০৭. সন্ধ্যার পর রাত্রির প্রথম প্রহরে
সন্ধ্যার পর রাত্রির প্রথম প্রহরে বসন্তদাস মন্দিরের চত্বরে এসে দাঁড়ায়। অধিকক্ষণ দাঁড়াতে হয় না–একটি ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে পশ্চাতে এসে বলে, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।