সোমজিৎ উপাধ্যায় হলায়ুধ মিশ্রের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিলেন। দেখছিলেন, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি বর্ণনার সময় হলায়ুধ ঈষৎ আন্দোলিত হলেও যখন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আসছে, তখন তিনি অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছেন। তখন তিনি যুক্তির প্রশ্ন তুলছেন, সম্ভাব্যতা অনুমান করছেন, এবং ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর ঘটনাবলীর নায়কদের শাস্তি না দিয়ে বরং সমর্থন করতেই আগ্রহী।
তিনি হতাশ হলেন। বললেন, শোনো হলায়ুধ, আমি জানি না, যবন জাতি সম্বন্ধে তোমার কি অভিমত। আপাতত তাদের শত্রু বলেই বিবেচনা করতে হবে। অপরদিকে সদ্ধমী বৌদ্ধদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন এই দুই শত্রুর মধ্যে কি একটির সঙ্গে মিত্রতা করা যায় না? বৌদ্ধরা এদেশবাসী, তাদের সঙ্গে আমাদের বহু সাদৃশ্য, দেশাচারে লোকাঁচারে আমরা ভিন্ন নই। কিন্তু যবন জাতি একেবারেই বহিরাগত। তারা এলে ধর্ম যাবে, কুল যাবে, জাতি যাবে। সেই সমূহ পতন থেকে দেশ ধর্ম ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য কি সদ্ধর্মীদের সঙ্গে মিত্রতা করা যায় না?
তুমি বৌদ্ধ পাষণ্ডদের সাথে মিত্রতা করতে বলছো? হলায়ুধ সন্দেহান্বিত দৃষ্টিপাত করেন।
হ্যাঁ, চিন্তা করে দেখো, তাহলে তোমার ধর্ম রক্ষা পাচ্ছে, জাতি রক্ষা পাচ্ছে, রাজ্য রক্ষা পাচ্ছে–তুমি নিজে রক্ষা পাচ্ছে। আমার এই আবেদনটি তুমি রাজার কাছে নিবেদন। করো।
তুমি উন্মাদ সোমজিৎ, হলায়ুধ উঠে বসলেন। বললেন, তুমি বিলক্ষণ উন্মাদ! রাষ্ট্র। কি একজন ব্যক্তির ইচ্ছায়, ক্ষণিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে চলে? আজ ইচ্ছা করলে আর অমনি সদ্ধর্মী বৌদ্ধরা তোমার বন্ধু হয়ে গেলো? সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা আর্য ধর্মের শত্রু, এ আজকের কথা নয়–বহুযুগ পূর্ব থেকেই এই শত্রুতা হয়ে আসছে। তুমি দেখো চিন্তা করে, ঐ ধর্মে স্বর্গ নরক নেই, যাগ যজ্ঞ নেই, বলিউপচার নেই, ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নেই, একেবারেই তৃণমূলে যে অন্ত্যজ থাকে, যারা যথার্থই তৃণভোজী–এ হলো তাদের ধর্ম। এদের প্রধান দেবতা শূকর পালকের গৃহে খাদ্যগ্রহণ করেছে, তুমি চিন্তা করতে পারো? তুমি আমাদের আর্য ধর্মের কথা ভাবো, এ ধর্ম উচ্চশ্রেণীর। আর্যত্বের অর্থ হলো। শ্রেষ্ঠত্ব–এর কৌলীন্য ভিন্ন প্রকার–এর দানধ্যান আছে, উৎসব আছে, মেধযজ্ঞ আছে, স্বর্গ–নরক আছে, এ ধর্ম কর্মফলে বিশ্বাস করে এবং মনে করে না যে, সকল মানুষ সমান হতে পারে। সুতরাং মূলেই রয়েছে বিরোধ। বহু শতাব্দীর চেষ্টায় বৌদ্ধশক্তি বিনষ্ট করা। গেছে–আজ আর কোথাও বৌদ্ধশক্তি বলে কিছু নেই। কিন্তু আজ যদি তুমি তাদের। প্রশ্রয় দাও, তাদের সঙ্গে মিত্রতা করো, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছো? চণ্ডাল হড়ডি ক্ষেত্রকর ইত্যাদি সকল ব্রাত্যজন হয়ে উঠবে স্বেচ্ছাচারী, তোমার দাসদাসী বলে কেউ থাকবে না, সামন্তপতিদের ধনজন গৃহ সংসার সমস্তই লুণ্ঠিত হয়ে যাবে। কোট্টপাল নেই, মন্ত্রী নেই, সেনাপতি নেই, সামন্ত নেই, প্রহরী নেই, কী ভয়ানক অবস্থা হবে, কল্পনা করতে পারো?
দীর্ঘ বক্তৃতা প্রায়। সোমজিৎ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। শেষে বললেন, তোমার সঙ্গে তর্কে নামার ইচ্ছা আমার নেই। বৌদ্ধ সদ্ধর্মীদের সঙ্গে মিত্রতা করলে সমস্তই ধ্বংস হয়ে যাবে–এ আমার বিশ্বাস হয় না হলায়ুধ। এদেশে বৌদ্ধ ও সনাতন উভয় ধর্মের সহাবস্থান ছিলো–সে তো মাত্রই শতাব্দ দুই পূর্বের ঘটনা। পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু কই, তাদের কালে তো ব্রাহ্মণ নিগ্রহের কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। বরং সকল ধর্মের লোক সহাবস্থান করতো। সনাতনধর্মী ব্রাহ্মণ যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো সদ্ধর্মী ভিক্ষুও।
শুনতে শুনতে হলায়ুধ মিশ্র বিস্ময় মানেন, এ কী কথা সোমজিতের মুখে? এই বয়সে এসে কি লোকটার চিন্তায় বিকৃতি দেখা দিয়েছে? বিরক্তি বোধ করলেন তিনি। বললেন, সোমজিৎ, এসব বিতর্ক কেন তুলছো? আমি বুঝতে পারছি না, এসব শুধুই তর্ক, না এসব কথা তোমার মনের। আজ যদি তুমি বলো, তখনও ব্রাহ্মণ ছিলো, ধর্ম ছলো, তাহলে তো তোমার সঙ্গে তর্কই বৃথা। যদি তখন এদেশে ব্রাহ্মণই ছিলো, তাহলে সনাতনধর্মীদের দীক্ষাদানের জন্য তোমার আমার পূর্বপুরুষদের এদেশে কেন আনা হয়েছিলো? আজ নিজের অতীতকেই বিস্মৃত হতে চাও, এই তোমার ধর্মরক্ষা! ধিক তোমার পাণ্ডিত্যে!
সোমজিৎ আহত হলেন। বুঝলেন, হলায়ুধ তার কথা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন, কোনো সাহায্যই তিনি করবেন না। তবু শেষ চেষ্টা করলেন। বললেন, রুষ্ট হয়ো না হলায়ুধ, আমি তোমার সুহৃদ, তোমার কাছে যদি অন্তরের কথা প্রকাশ না করি, তাহলে কার কাছে করবো? আমার মনে হয়, ধর্ম জাতি উভয়ই এখন সংকটাপন্ন। যদি বিহিত না করা হয়, তাহলে সমস্তই ধ্বংস হবে। এতোকাল যা করা হয়েছে তা ভুল। তাতে বিরোধ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঘৃণা, সন্দেহ ও প্রতিহিংসার ভাব লালিত হয়ে এমন আকার ধারণ করেছে যে এখন পরস্পর প্রত্যেকেই শক্র। এ না করে আমরা যদি প্রীতির কথা বলি, সহাবস্থানের কথা বলি, মিলনের কথা বলি–তাহলেই তো ঘৃণা দূর হয়, সন্দেহ যায় ও প্রতিহিংসার অবকাশ থাকে না। চিন্তা করে দেখো তুমি। বস্তুকণা বিচ্ছিন্ন হলে তার একরূপ আর ঐ বস্তুকণাই ঘনসংবদ্ধ হলে তার অন্যরূপ। আজ যদি এমন হয় যে, যবনাক্রমণের বিরুদ্ধে রাজার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রকৃতিপুঞ্জও প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে, তাহলে এই যবনদের আক্রমণ আর কয়দিন? তুমি মহামন্ত্রী, আমার কথাটি বিবেচনা করে দেখো। অন্তত রাজসভায় আমার প্রস্তাবটি দিয়ে দেখো।