কেন, পিতঃ, গৌড়ীয় রীতিও তো একটি রীতি।
হ্যাঁ, এক প্রকার রীতি–কিন্তু সে রীতি অক্ষমের, আর্যত্বের তোমরা আর কিছু রাখলে না।
ঐ সময় দূরে দ্বারদেশে রাজপ্রহরীদের দেখা গেলো। পরে দেখা গেলো, একখানি দোলা। হলায়ুধ মিশ্র আসছেন।
নিকটে এসেই হলায়ুধ বাল্যবন্ধুকে উদ্বাহু হয়ে আলিঙ্গন করলেন। হলায়ুধ এখনও শক্তিমান–দেহ ঋজু, বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনের মতো। কপালে চন্দন–লেখা, শিখাগ্রে পূজার পুষ্প, উপবীতখানি শুভ্র–সমগ্রদেহে পৌরুষের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সোমজিৎ বললেন, তুমি দেখছি সেইরূপই আছো।
হ্যাঁ, বলতে পারো, হলায়ুধ বলেন,তবে এ কৃতিত্ব আমার নয়, ব্রাহ্মণীর–তিনি যেভাবে রাখেন, সেইভাবেই থাকি।
কিন্তু আমি কিরূপ বৃদ্ধ হয়েছি দেখেছো?
ও কিছু নয়, দেহ দেখে কিছুই বোধগম্য করা যায় না, অন্তরটি বৃদ্ধ না হলেই হলো।
ক্ষণপরে পুনরায় হলায়ুধ বলেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যবস্থা কি জানো?
কি, সোমজিৎ কৌতূহলী হন।
নিজের নিকট কিছুই না রাখা, নিজেকেও না রাখা। নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দাও, দেখবে যথার্থ যত্ন হচ্ছে, এবং তোমার দিনও অতিবাহিত হচ্ছে দায়হীন আনন্দের মধ্য দিয়ে।
কৌতুকালাপে কিছুক্ষণ গেলে সোমজিৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। বললেন, হলায়ুধ, তুমি রাজপুরুষ, তোমার কাছেই আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি, যদি আমার আবেদনটি তোমার অনুমোদন লাভ করে, তাহলে আমি সেটি মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের পাদপদ্মে নিবেদন করতে চাই।
হলায়ুধ গম্ভীর হলেন। সোমজিৎকে তিনি বাল্যকাল থেকে জানেন। সকল ব্যাপারেই সে গভীর এবং গুরুপ্রশ্ন ব্যতীত অযথা চিন্তা করে সময় ব্যয় করে না। হলায়ুধ বললেন, তোমার আবেদনটি কী, সেইটি আগে বলল।
ঐ কথার পরও সোমজিৎ ইতস্তত করেন। তিনি নিশ্চিত নন হলায়ুধ কতখানি আগ্রহী হবেন শুনতে। তথাপি তিনি আরম্ভ করলেন
তুমি জ্ঞাত কিনা জানি না, পুনর্ভবা তীরে আমাদের অঞ্চলে হরিসেন অত্যন্ত প্রতাপশালী সামন্তপতি। সম্প্রতি ঐ অঞ্চলে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের গমনাগমন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো–বিশেষত অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে তাদের হৃদ্যতা হয়ে উঠেছিলো নিবিড়। ডোম রমণীরা কেমন হয় নিশ্চয় শুনেছো। তারা যেমন শিথিল–শাসনা তেমনই উদ্ধৃঙ্খল, তাদের এই স্বভাব প্রায় সর্বত্র। ঐ অঞ্চলে পিপ্পলী হাট নামক একটি হাট আছে। ঐ হাটে একদা হরিসেনের অনুচর বজ্রসেন কয়েকটি কুলটা ডোম রমণীকে শাসন করতে যায়। ফল হয় ভয়াবহ, হাটের ক্ষিপ্ত মানুষ বজ্ৰসেন ও তার দুই অনুচরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে–তাদের দেহ এমনই ছিন্নভিন্ন করে দেয় যে তাদের পরিচয় উদ্ধার করাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। সামন্ত হরিসেন ঐ ঘটনার প্রতিশোধ নেন–এবং সেই প্রতিশোধটিও ভয়ঙ্কর। ঐ পিপ্পলী হাটেই কয়েকদিন পর বিশাল এক জনসমাবেশে একটি কুলটা ডোম রমণীর মধ্যদেশে অগ্নিতপ্ত লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় এবং তার দুই শিশুপুত্রকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। একটি সদ্ধর্মী ভিক্ষুকে ঐ স্থানেই অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। হত্যা করা হয়।
হলায়ুধ মিশ্র শুনছিলেন। বললেন, এ যে দেখছি একেবারেই পাশবিক কাণ্ড।
হ্যাঁ, পাশবিক কাণ্ডই বলতে পারো। সোমজিৎ পুনরায় বলতে থাকেন, কিন্তু হরিসেন। সেখানেই নিরস্ত হননি। আমাদের নিজগ্রাম উজুবটের উত্তরপাটক পল্লীটি হরিসেনের অনুচরদের হাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বহু শিশু, নারী ও বৃদ্ধ নিহত হয়। এবং আশ্চর্য কাণ্ড কি জানো, ঐ আক্রমণের মুহূর্তেই পল্লীটি পুনরপি আক্রান্ত হয় অন্য আর একদল অশ্বারোহী সেনাদল দ্বারা। শোনা যায়, তারা পশ্চিম দেশাগত এবং জাতিতে যবন। কোনদিক থেকে আগমন এবং কোথায় প্রস্থান, তার কিছুই জানা যায়নি। তবে প্রকৃত কথা এই যে, উজুবট গ্রামের উত্তরপাটক পল্লীটি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
হলায়ুধ মিশ্র সংবাদটি শুনে ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, তুমি যবন সেনাদলের কথা কী জানো, তাই বলো।
না হলায়ুধ, আমি ও বিষয়ে কিছুই জানি না, সোমজিৎ জানান। বলেন, এবং এ বিষয়ে আমি কিছু বলতেও আসিনি। যে কারণে আমি রাজধানীতে এসেছি সেটি শুনতে হবে তোমাকে। পিপ্পলী হাট ও উজুবটে ঘটনা দুটি ঘটে যাওয়ার পর থেকে সমগ্র অঞ্চলটি হয়ে রয়েছে সন্ত্রস্ত। গ্রামবাসী কেউ গৃহে রাত্রিযাপন করে না। কোনো রাজ–পুরুষকে দেখামাত্র মানুষ শত হস্তেন দূরাৎ পলায়ন করে। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গৃহীদের গৃহে দাসদাসী নেই। ভূমি কর্ষিত হয় না, বীজ উপ্ত হয় না, শস্য কর্তনের লোক নেই–এক ভয়ানক অবস্থা সর্বত্র। এমতাবস্থায় মহারাজের কিছু করা উচিত। যদি তিনি তাঁর সামন্তদের শাসন না করেন, তাহলে ঐ অঞ্চলগুলিতে মানুষ থাকবে না। তাই আমার আবেদন, মহারাজ তার সামন্ত হরিসেনকে আদেশ দিন, যেন তিনি প্রজাপীড়ন না করেন–ঐ প্রকার দুষ্কর্ম যেন আর না হয়।
পণ্ডিত, কত ধান্যে কত তণ্ডুল যদি বুঝতে! হলায়ুধ হাসতে হাসতে বললেন। জানালেন, তোমার কথা আমি মহারাজের গোচরে আনতে পারি–এমনকি তোমাকেও আমি রাজসভায় নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু মনে হয় না, তাতে তোমার লাভ হবে। প্রথমত, সামন্তদের রাজা শাসন করবেন না–কারণ, বহিঃশত্রু রাষ্ট্রের দ্বারদেশে উপনীত। দ্বিতীয়ত, সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের আচরণ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। সুতরাং বিষয়টি শ্রবণ করে মহারাজ যখন মন্ত্রীদের অভিমত চাইবেন তখন মন্ত্রীদের তো যুক্তিসঙ্গত অভিমত দিতে হবে। বলো, কে তখন অযৌক্তিক অভিমতটি দেবে? বিশেষত একজন সামন্তপতির বিরুদ্ধে যেখানে অভিযোগ। উঁহু, অসম্ভব।