কিন্তু জনরবের পর জনরব শুনছেন। যদি আজ শুনলেন যে, রাজসভার এখন মান্যপুরুষ গোবর্ধন আচার্য, তো কালই আবার জানলেন, গোবর্ধন আচার্য নয়, প্রকৃত পুরুষ হচ্ছেন মহাপণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্র। পরদিন আবার জানতে পারলেন–ও সমস্ত কিছুই সত্য নয়। মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, পাণ্ডিত্যের পীড়নে ইদানীং বিরক্ত হন। এখন রাজসভার আনন্দদানকারী নট গাঙ্গোকই হচ্ছে মূল ব্যক্তি। যদি কেউ পারে, তো সেই পারবে, রাজার সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে। আর একজন আবার বললো, রাজসভার যে সংবাদ শুনছেন কোনোটিই সত্য নয়–এসব সংবাদের আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। রাজসভায় কিছুই হয় না, মহারাজের অতো সময় কোথায়? আপনি বরং রানী বল্লভার সাক্ষাপ্রার্থী হন। রানী বল্লভা একে যুবতী, তায় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা। রাজা যা-কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা শয্যাতেই, বিশ্রাম গ্রহণকালে।
জনরবগুলির ভিত্তি যে কী, এবং কেন যে ঐ প্রকার একের-পর-এক জনরবের জন্ম। হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যাই কেউ তাকে দিতে পারলো না। না তার কন্যা, না জামাতা।
রাজপথটি প্রশস্ত। অপরাহ্নের রৌদ্র এসে পতিত হয়েছে অট্টালিকাসমূহের প্রাচীর গাত্রে। পথচারীদের সংখ্যা এখনও যথেষ্ট নয়। সম্ভবত গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতাই কারণ। আষাঢ় মার্তণ্ডের প্রচণ্ড তেজ সংসারকে ঝলসিত করে দিচ্ছে। অনুমান হয়, দুই চারিদিনের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। সোমজিৎ বুঝলেন, শীঘ্রই তাঁকে স্বগ্রামাভিমুখে যাত্রা করতে হবে–নতুবা বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেলে পথে কষ্টের সীমা থাকবে না।
দুই পার্শ্বে গৃহাঙ্গনের বৃক্ষছায়ায় বিশ্রামরত নগরবাসীদের দেখতে দেখতে চললেন সোমজিৎ। সম্ভবত গন্তব্যের নিকটে এসে গিয়েছেন। জলসিক্ত বাতাসের স্পর্শ অনুভব করছেন দেহে। গঙ্গাতীরেই তো চতুস্পাঠীটির অবস্থান বলে শুনেছেন। চক্ৰায়ুধ মিশ্র প্রতিষ্ঠিত এই নব চতুষ্পাঠীটি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে, জামাতা কেশবাচার্য এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তিনিই হলায়ুধের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন। হলায়ুধ নাকি প্রতি পক্ষে একটি অপরাহু এ স্থানে অতিবাহিত করেন। আজই সেই দিনটি, এবং অপরাহ্নকালও সমাগত। কষ্ট হচ্ছে তার দ্রুত পদক্ষেপণ করতে।
কন্যা সরস্বতী বলেছিলো, পিতঃ, ঐ দীর্ঘপথ পদব্রজে যাবেন না, আমি একটি দোলার। ব্যবস্থা করে দিই।
সোমজিৎ সম্মত হননি। সহাস্যে বলেছিলেন, মাতঃ ঠাকুরের কাছে এই প্রার্থনা করো যে, আমি যেন একবারই মানুষের স্কন্ধে উঠি, বারংবার ওঠা নামায় এ বৃদ্ধের বড় কষ্ট হবে।
অপরাহ্নকাল বলেই চতুষ্পাঠীটি নীরব। ইতস্তত কয়েকজন স্নাতককে দেখা যাচ্ছে। বালক ও কিশোরের দল যে কোথায়, বোঝা যাচ্ছে না। বৃহৎ চতুঃশালা সম্মেলক–গৃহটির পর বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। মধ্যে একদিকে দুটি বকুল বৃক্ষ, অন্যদিকে দুটি চম্পক। বৃক্ষলতা, পুষ্প ও পত্র–পল্লবে স্থানটি স্নিগ্ধ ও মনোরম। কেশবাচার্য দ্বারেই ছিলেন। জানতে চাইলেন, আপনি কি বৃক্ষতলে উপবেশন করবেন, না অলিন্দে?
বৃক্ষতলেই বসি, কি বলো? সোমজিৎ হাসলেন।
একটি তরুণ ব্রাহ্মণ সম্মুখে এসে প্রণাম করলে সোমজিৎ অবাক হলেন। বললেন, এটিকে যেন পরিচিত মনে হচ্ছে?
সেকি, মনে নেই আপনার? এ তো আমার অনুজ, মাধব–এবার স্নাতক হলো।
দীর্ঘায়ু হও বৎস। তুমি দেখছি দিব্য যুবাপুরুষটি হয়ে উঠেছো। তোমার কী ভালো লাগেন্যায় না স্মৃতি? নাকি ব্যাকরণ?
আজ্ঞে না, আমি কাব্যানুরাগী।
তা বটে, এই বয়সে কাব্যেই তো শিক্ষার্থীর অনুরাগ থাকে–কী পাঠ করছো এখন?
তরুণটির মুখে সলজ্জ হাসি দেখা গেলো। বললো, আমার বানভট্ট, ভবভূতি, দণ্ডী এঁদের ভালো লাগে। তবে এখন জয়দেব পাঠ করছি।
সে কি। সোমজিৎ অবাক হলেন। জয়দেব গোস্বামী কি তাঁর গীতগোবিন্দ সমাপ্ত করেছেন? তার পুঁথিও কি প্রস্তুত হয়ে গেছে? জানতে চাইলেন, তোমরা সম্পূর্ণ পুঁথি পেয়েছো?
আজ্ঞে না, কবি স্বয়ং আমাদের কাছে অংশে অংশে দিচ্ছেন এবং সেই অনুক্রমে আমরা লিপি প্রস্তুত করছি।
ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন সোমজিৎ। রাঢ়ের সেই যুবকটি–পীত ধটিকা পরিধানে, উত্তলবাসীদের মতো মস্তকোপরি প্রকাণ্ড স্কুল শিখাঁটি, উপবীতখানিও রজ্জুসদৃশ সেই গ্রাম্য যুবকটি একদা সকলের মন জয় করে নিলো। ঐ কবিসভায় সোমজিৎও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর শ্লোকও প্রশংসিত হয়েছিলো। কিন্তু জয়দেবের শ্লোকাবলীর মতো নয়। তথাপি অনেকের মত সোমজিতেরও সন্দেহ ছিলো। তারও মনে হয়েছিলো, ঐ পদ চলবে না–একেবারেই প্রাকৃতগন্ধী। কিন্তু চললো–রাজসভা সাদরে গ্রহণ করে নিলো। জয়দেব গোস্বামীকে।
জয়দেব বুঝি তোমাদের অত্যন্ত প্রিয়? সোমজিৎ তরুণটির মুখোপরি দৃষ্টি রাখলেন।
আজ্ঞে, তরুণ মাধবাচার্য পুনরায় সলজ্জ মুখখানি নমিত করে। তারপর বলে, তবে প্রাকৃত পদাবলী বোধ হয় আমার অধিকতর প্রিয়।
কেন? সোমজিতের ভ্রূ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। দেখা যায়, কেশবাচার্যের দৃষ্টিও আর সরল নেই।
ঐ প্রকার ভ্রূকুটি কুটিল প্রশ্ন হওয়াতে মাধব প্রথমে অপ্রস্তুত, পরে শঙ্কিত হয়। অনুমান করে, তার কথায় সম্ভবত বয়োজ্যেষ্ঠ দুজনই আহত হয়েছেন। সে অনুমতি প্রার্থনা করে। বলে, আমার কাজ আছে, অনুমতি দিন, আমি যাই।
তরুণটি প্রস্থান করলে সোমজিৎ মন্তব্য করলেন, এই তাহলে তোমাদের বিদ্যাদান। রুচি তো দেখছি ক্রমেই প্রাকৃত হয়ে যাচ্ছে–এ তো ঠিক নয়।