লীলা বলে, জানি না।
গ্রাম প্রান্তে উপনীত হলে সিদ্ধপা দাঁড়ালেন। ঊর্ধ্বাকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, নক্ষত্রমালা সাক্ষী, রাত্রির অন্ধকার সাক্ষী, তোমার আমার নিঃশ্বাস বায়ু সাক্ষী শ্যামাঙ্গ, লীলাবতীকে আমি তোমার হাতে সমর্পণ করলাম, ওকে তুমি রক্ষা করো। তোমাদের বিবাহ হবে না–কেননা শাস্ত্রের কোনো বিধান নেই যে তোমাদের বিবাহ হয়–এ বড় দুষ্কাল বৎস, জানি, তোমাদের সংসার হবে না–তথাপি আমি তোমাদের মিলিত করে দিলাম–পারলে যোব্রত পালন করো, শিব তোমাদের মঙ্গল করুন।
মাতুলকে প্রণাম করে দুজনেই দ্রুত পদক্ষেপে সম্মুখে অগ্রসর হলো। জ্যৈষ্ঠ গত হয়ে আষাঢ়ের আরম্ভ এখন। কিন্তু সৌভাগ্য যে বর্ষা এখনও নামেনি। আকাশের নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে দুজনে পথ অতিক্রম করে চললো। লীলাবতীর মুখে কোনো কথা নেই। বস্ত্রের অঞ্চলটি মাথায় তোলা, তথাপি বোঝা যায়, অবগুণ্ঠনবতী এই রমণী মাথা নীচু করতে জানে না। সঙ্কোচহীন একটি দৃপ্ত ভঙ্গী তার মস্তককে উন্নত করে রেখেছে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো, ওষ্ঠদ্বয় দৃঢ় সংবদ্ধ, দৃষ্টি দিগন্ত লগ্ন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ জড়তাবিহীন। একবার শ্যামাঙ্গ বললো, একটু দ্রুত চলো।
লীলাবতী মৃদু স্বরে জানতে চাইলো, কেন?
শীলনাথের লোক অনুসরণ করতে পারে।
করুক।
ক্ষুদ্র একটি শব্দ। কিন্তু শতকথা যেন সে ঐ একটি শব্দে উচ্চারণ করে।
শ্যামাঙ্গ পুনরায় বলে, লীলা, আমরা কোথায় চলেছি জানো?
ঐ কথায় মস্তক আন্দোলিত করে লীলাবতী, না। তারপর বলে, সম্ভবত মরতে।
না, কৌতুকের কথা নয় লীলা, শ্যামাঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলে, তোমার জানা প্রয়োজন, তুমি কোথায় চলেছো–তোমার মাতুলের কথাগুলি নিশ্চয়ই শুনেছো?
না, আমার প্রয়োজন ছিলো না।
কি কাণ্ড, নারী জাতি দেখছি সত্যিই ভয়ঙ্কর! এবার শ্যামাঙ্গের কণ্ঠে ঈষৎ কৌতুক ধ্বনিত হয়।
লীলা ঐ কথায় মুহূর্তেক দাঁড়ায়। তারপর বলে, এভাবে পথে বিলম্ব করো না তো! সম্মুখে আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হবে।
রাত্রি তখন শেষ হয়ে আসছে। পূর্বাকাশে আলোকোদ্ভাস, বনকুকুট ডাকছে পথিপার্শ্বের ঝোপগুলিতে। একটি গোধিকা বামদিক থেকে দক্ষিণে গেলো। দিগন্তে ঐ সময় মেঘ দেখা গেলো–তবে ঐ মেঘ ঝড়েরও নয়, বৃষ্টিরও নয়। সম্মুখে একটি গ্রাম দেখা যায়। শ্যামাঙ্গ শুধালো, এখানে ক্ষণেক বিশ্রাম নেবে? না, লীলাবতী জানায়, আমি ক্লান্ত নই পরবর্তী কোনো স্থানে বিশ্রামের কথা চিন্তা করবো।
কিন্তু আমি যে বিশ্রাম চাই? শ্যামাঙ্গের স্বরে কি কৌতুক?
তুমি দেখছি নারীরও অধম। ধিক তোমার পুরুষ জীবনে।
এই তো লীলা আবার সহজ হচ্ছে। শ্যামাঙ্গ উৎফুল্ল হয় মনে মনে। লীলাবতীর হাতখানি সে ধরে। বলে, লীলা ক্ষণেক দাঁড়াও, আমি তোমাকে দেখি।
তুমি আমাকে দেখবার কে? লীলার কণ্ঠে শাসন।
শ্যামাঙ্গ অপ্রস্তুত বোধ করে। বলে, আমাদের যে মিলিত করে দিয়েছেন তোমার মাতুল।
সে তো যোগব্রতের মিলন, সংযম আচরণ করতে হবে দুজনকেই।
হঠাৎ লীলাবতী দাঁড়ালো। পূর্বাকাশ এখন পরিষ্কার–পরস্পরের মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। বললো, শ্যামাঙ্গ, তুমি কী চাও বলো তো?
আমি তোমাকে চাই, অকপটে দাবি করে শ্যামাঙ্গ।
আমাকে চাও, অর্থ কি আমার এই দেহটিকে চাও। দেহ পেলেই তোমার চলবে?
শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে। কী বলতে চায় এই নারী? সে বলে, লীলা, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
উত্তম কথা, ভালোবাসো বলেই তো আমাকে চাও তুমি, তাই না? তোমার কথা আমার কাছে দুর্বোধ্য নয়। বলো, আমার এই দেহটি চাও? যদি অতীব প্রয়োজনীয় মনে করো, তাহলে নাও।
এই কথা বলে সে উধ্বাঙ্গের বস্ত্র অপসারিত করলো। শ্যামাঙ্গ দেখলো তার গ্রীবা, সুগোল স্কন্ধ দুটি, উন্নত ও মহিমান্বিত স্তন যুগল, ক্ষীণ কটিদেশ–
বলো, আরও দেখতে চাও, তাহলে নিম্নাঙ্গের বস্ত্রও আমি অপসারিত করি।
শ্যামাঙ্গের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে আহত বোধ করে। বলে, তুমি কি আমাকে লম্পট ভেবেছো?
না, তা কেন ভাববো, লীলাবতীর কণ্ঠ অতীব সুস্থির।
তাহলে তুমি ওভাবে কেন নিজেকে অপমানিত করলে?
শ্যামাঙ্গ, তুমি কি কলহ করবে পথে? লীলাবতী বলে, আমি তোমাকে মনে স্থান। দিয়েছি সেই প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে, মনে আছে তোমার, পুনর্ভবা তীরের বটতলের উচ্চ বেদীটির কথা? আমি তারপর থেকে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তোমাকে কামনা করেছি। লম্পট মদ্যপ অথবা নির্বোধ লোক নিয়ে রমণীরা সংসার করছে না? আমিও হয়তো একদিন অভিমন্যু দাসের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু তুমি এলে আমার সম্মুখে, আর জীবনের অর্থ আমার নিকট অন্যরূপ হয়ে গেলো। এখন আমার পূর্বজীবন বলে কিছু নেই, আমি মনে করি, সেই জীবন উজুবটেই ভস্মীভূত হয়ে গেছে। তুমি ব্যতীত এখন আমার কেউ নেই। আমার দেহ মন আমি সমস্তই তোমাকে দান করে রেখেছি–তবু তুমি কেন লোভী বালকের মতো আচরণ করো, বলো? প্রিয়তমাকে বক্ষলগ্ন করার এই কি সময়? এই কি স্থান?
লীলাবতীর সমস্ত সংযম ঐ কথার পর ধসে পড়ে, তার কণ্ঠ রোদনউদ্বেল হয়ে ওঠে। সে শ্যামাঙ্গের বক্ষে নিজেকে সমর্পণ করে।
এ কি দেখছে শ্যামাঙ্গ, কে এই রমণী, যে তার বক্ষে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লো? সে দুহাতে লীলাবতীকে বক্ষে ধারণ করে রাখে। তারপর ক্ষমা চায়, লীলা, ক্ষমা করো আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি–ক্ষমা করে দিও আমাকে।
০৬. সোমজিৎ লক্ষ্মণাবতী
সোমজিৎ লক্ষ্মণাবতীর অভিজাত পল্লী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে রাজপথ অতিক্রম করছিলেন। বার্ধক্যের কারণে স্বভাবতই ঋজুতা হারিয়েছেন–যেমন দেহের, তেমনি মনেরও। তথাপি তাঁকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে রাজধানীতে আসতে হয়েছে। মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। রাজধানীতে এসে অবধি নানান জনরব শুনছেন। কেউ বলছে, বৃদ্ধ মহারাজ রাজধানীতে নেই, গঙ্গাতীরে গিয়েছেন। কেউ বলছে, তিনি অত্যধিক রুগ্ন, রাজকার্য এখন দেখেন না। এক স্থানে আবার শুনলেন, মহারাজ নাকি যবনাক্রমণ আসন্ন দেখে প্রাণরক্ষার জন্য পলায়ন করেছেন। প্রকৃত সংবাদটি যে কী, কিছুই জানবার। উপায় নেই। হলায়ুধ মিশ্র তার সতীর্থ ছিলেন গুরুগৃহে। সেই সূত্রে এখনও উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা রয়েছে। বর্ষকাল পূর্বেও তিনি রাজধানীতে এসেছিলেন–তখনও সাক্ষাৎ হয়েছে। এবার তিনি হলায়ুধের মাধ্যমে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের নিকটে যেতে চান। মহারাজের নিকট তিনি একটি আবেদন জানাবেন।