হঠাৎ লীলা বাধা দেয়। তখন তার চক্ষু দুটির ভিতরে কোমল একটি আলো ফুটে উঠেছে। বিষাদ–করুণ মুখখানিতে অস্পষ্ট হাসির ছায়া দেখা যাচ্ছে। সে শ্যামাঙ্গের হাত ধরে বলে, অতো কথায় কি প্রয়োজন–তুমি অহেতুক অধিক কথা বলল। আজ রাত্রেই এ স্থান ত্যাগ করলে হয় না? ঐ বনের মধ্যে পথ নেই? ও পথে কি ব্যাঘ ভল্লুকের সংখ্যা অত্যধিক?
ঐ কথা বলেই লীলাবতী প্রস্থান করে। শ্যামাঙ্গ নির্বোধের মতো তার গমনপথে চেয়ে থাকে। এ কী ঘটলো? এ যে কল্পনারও অতীত। লীলাবতী সমাজ সংসারের কথা কি কিছুই চিন্তা করতে চায় না? পথের বিপদ আপদের বিবেচনাও কি তার নেই?
কিন্তু ঐদিন সন্ধ্যাকালেই মাতুল সিদ্ধপা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বহুদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বললেন, আমি পুনর্ভবার উভয় তীরের গ্রামগুলি দেখে এলাম। অবস্থা বড় বিপজ্জনক। সর্বত্রই আশঙ্কা এবং ত্রাস। দক্ষিণের এক সামন্তপতি দুখানি গ্রাম ধ্বংস করেছেন–একখানি হড়ডিদের, অন্যখানি ডোমদের। এখন তোমাদের এ স্থানে অবস্থান করাই উত্তম।
শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর কথাটি জানালে সিদ্ধপা গম্ভীর হলেন। এবং বললেন, বৎস, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না। কেননা শীলনাথের আমি দীক্ষাগুরু। আমার যোত কঠোর সংযম এবং রিপু শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি কামাচারী নই– শীলনাথেরও হবার কথা নয়। তবু আমি গোপনে সন্ধান নিয়ে দেখবো। যদি তোমাদের কথা সত্য হয়, তাহলে এ স্থানে আর কোনোক্রমেই থাকা যাবে না। আর যদি তোমাদের কথা সত্য না হয়, তাহলে কিন্তু কঠিন শাস্তি দেবো তোমাকে।
মহাশয়, আমি বলেছি, কথাটি আমার নয়, আপনার ভাগিনেয়ীর, শ্যামাঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, আপনি বরং তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।
লীলাবতী রাত্রে এসে জানায়, যাত্রা স্থগিত রাখতে হবে, মাতুলের উপস্থিতিতে পলায়ন করলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে।
শ্যামাঙ্গ হাত ধরে, লীলা, তোমার মত পরিবর্তিত হয়নি তো?
লীলা স্থির হয় মুহূর্তের জন্য। তারপর চোখের মধ্যে দৃষ্টিপাত করে বলে, তুমি কি উন্মাদ হয়েছো? আমার যে আর গত্যন্তর নেই, তুমি বুঝতে পারো না?
সিদ্ধপার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়াটি ইদানীং সর্বক্ষণ থাকে। তিনি উজুবটেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে অনেক সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। যেমন মহাসামন্ত হরিসেন এখন রাজধানীতে। ওদিকে সামন্তপতিদের উপর আদেশ হয়েছে, যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হবে। রাজজ্যোতিষেরা নাকি বলেছেন, গ্রহ নক্ষত্রাদির অবস্থান বিপজ্জনক–রাজ্যনাশ অবশ্যম্ভাবী, এবং তা ঘটবে যবনদেরই হাতে। সুতরাং জ্যোতিষীদের বিধান, যজ্ঞ করো, যজ্ঞের মন্ত্রেই যবনের উপদ্রব দূরীভূত হবে।
একদা রাত্রিকালে অকস্মাৎ শ্যামাঙ্গকে শয্যা থেকে ডেকে তুললেন সিদ্ধপা। বললেন, চলো, তোমাকে যোত গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাকে দীক্ষাদান করবো।
শ্যামাঙ্গ কিছুই বলার অবকাশ পেলো না। একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন শ্যামাঙ্গকে। সেখানে কক্ষের মধ্যস্থলে ভূমিতে চক্র ও রেখা অঙ্কিত দেখলো শ্যামাঙ্গ। ঐ মধ্যস্থলেই ধূপ জ্বলছে, প্রদীপ জ্বলছে, কয়েকটি পদ্মফুল সেখানে, সেই সঙ্গে আবার জবা ফুলও। ঐ মধ্যস্থলেই দেখলো, বসে আছে লীলাবতী। শীলনাথ দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। সে বললো, গুরুদেব, আজ রাত্রে তো কোনো শুভলগ্ন নেই, উপরন্তু জাতক জাতিকার কায়াশুদ্ধিরও একটি ব্যাপার আছে–অনুষ্ঠানটি পরে করলে হতো না?
সে চিন্তা আমার, সিদ্ধপা জানালেন। বললেন, কালযোগ বলে একটি কথা আছে আর কায়াশুদ্ধির তুমি কী জানো? আমি জানি, আমি কী করছি, আমাকে শুভকার্য সমাধা করতে দাও, বাধা দিও না–এই বলে তিনি দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।
শ্যামাঙ্গের কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না। উচ্চৈঃস্বরে কয়েকবার মন্ত্র পাঠ করলেন সিদ্ধপা, তারপর নিম্নস্বরে বললেন, এ তোমাদের দীক্ষা নয়–দীক্ষাগ্রহণের জন্য সাধনা প্রয়োজন–তা তোমাদের নেই। আমি লীলাবতীর কথা চিন্তা করে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। আমাকে এ স্থান ত্যাগ করে দূর দেশে চলে যেতে হচ্ছে। এই রাত্রেই তোমরা এ গ্রাম ত্যাগ করে চলে যাবে, যত দ্রুত সম্ভব, দূরে চলে যেও। পথিমধ্যে কোথাও বিলম্ব করবে না। পুন্ড্রনগরে উপনীত হলে তখন বুঝবে যে, আর ভয় নেই। পথিমধ্যে যদি কোথাও কোনো যবন কেন্দ্র দেখো, তাহলে সেখানে আশ্রয় নেবে।
ঐ পর্যন্ত বলেই তিনি অগ্নিতে ধূপ নিক্ষেপ করলেন। অগ্ন্যায় স্বাহাঃ বললেন কয়েকবার, তাতে কক্ষটি ধূপের গন্ধে এবং ধূমে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। শেষে দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। ডাকলেন শীলনাথকে। বললেন, তোমার কে দীক্ষাপ্রার্থী আছে, তাকে ডেকে নিয়ে এসো।
গুরুদেব, সে তো ভিন্ন গ্রামে থাকে।
তবু ডেকে আনো, রাত্রির শেষ যামে তার দীক্ষা হবে।
শীলনাথ চলে গেলে তিনি পুনরায় দ্বার রুদ্ধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার দ্বার উন্মুক্ত করে শ্যামাঙ্গকে ডেকে বললেন, চলো, আমি তোমাদের পথে রেখে আসি।
মধ্যরাত্রির নিঃশব্দতা এবং অন্ধকার। নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে শ্যামাঙ্গ। তার মনে প্রশ্ন জাগে, এ তুমি কোথায় চলেছো শ্যামাঙ্গ? একি তোমার জীবনের পথে যাত্রা? নাকি এই পথেই তোমার মরণ? সে পার্শ্বে সহগামিনী লীলাবতীকে জিজ্ঞাসা করে মৃদুস্বরে, আমরা কোথায় যাচ্ছি লীলা?