আবার একেক সময় মনে হয়, এ হলো এক প্রকার ক্ষয়। জরা এসে তোমার দেহের শক্তি হরণ করছে, তোমার মনের চিন্তাকে স্থবির করে দিচ্ছে, তোমার উদ্যমকে বিনষ্ট করছে। তোমার অস্তিত্বকে ধারণ করে যে শক্তি, সেই শক্তিই ক্ষয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। ফলে তোমার দেহ মন কিছুই আর তোমার নয়। এ হলো সেই পুত্তলির মতো যার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গাদি আর একত্র থাকছে না। তোমার হস্তপদ তোমার নয়। সমস্তই ক্ষয় হয়ে, শিথিল হয়ে, ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংসারেরই কি কোনো গঠন থাকে?
অথচ সংসারই মূল। আমার হস্তপদাদি আমার থাকতে হবে–চক্ষু দুইটিকেও আমি সংলগ্ন চাই। স্ত্রী–পুত্র, পরিবার–পরিজন, গৃহ, কর্মক্ষেত্র সমস্তই আমি সংলগ্ন চাই। ঐ সব সংলগ্ন না থাকলে আমি যে আর আমি থাকতে পারি না। সুতরাং এই সংলগ্নতাই সংসারের সৃষ্টি করে। এরই অন্য নাম প্রেম। প্রেমে জগৎ হয়ে ওঠে একান্ত আপন। সৃজনের আধার সংসার, সংসারের আধার আবার জগৎ। যে পথেই অগ্রসর হই, প্রেম ব্যতীত জগৎ নেই।
একাকী মনের চিন্তা এসব। একদিনের নয়। বাণিজ্য যাত্রার সময় থেকে আরম্ভ। নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসব চিন্তার জন্ম হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে–অসংলগ্নভাবে। পরে এগুলি ক্রমশ স্পষ্টতর হয়েছে শ্বশুরালয়ে অবস্থানকালে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি ঘটবার পর, যখন ভিক্ষুরা একাদিক্রমে তার কাছে আসতে আরম্ভ করে, তখন।
কিন্তু এখন এসব চিন্তার কি আর আদৌ কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে? সমস্ত কিছুর এখন ছিন্নভিন্ন অবস্থা। মস্তিষ্কের চিন্তার যেমন, বাইরের দৃশ্যাবলীরও তেমনই।
সমস্ত পথ তার মনে অসংলগ্ন আরও নানান চিন্তার উদয় হচ্ছিলো। সেই সঙ্গে আবার মায়াবতীর প্রণয়ভাষণের কথাগুলিও থেকে থেকে কর্ণকুহরে মর্মরিত হচ্ছে তখন। ফলে সে নিজের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছিলো নিমজ্জিত। পথের প্রতিকূলতা তার সম্মুখে কোনো বাধারই সৃষ্টি করতে পারেনি।
খিল ভূমির মধ্য দিয়ে পথ। কোথাও ঈষদুচ্চ ঝোপ, কোথাও আইল, কোথাও বা জল প্রবাহিনী নালিকা। কিন্তু কিছুই তার বোধগোচর হচ্ছিলো না। তবে সৌভাগ্য যে। আকাশে ছিলো পূর্ণচন্দ্র এবং তার দৃষ্টিশক্তিও ছিলো প্রখর। তার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এবং স্বাভাবিক অনুভূতিগুলি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতোই ছিলো সচল।
অবশেষে রাত্রির মধ্যমে পুনর্ভবা তীরের একটি হাটে এসে উপস্থিত হলো। পদযুগল আর বশে ছিলো না তখন। একটি হট্টকুটিরের চালার নীচে ভূমিতেই সে শয়ান হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্ত ছিলো সে। কিন্তু নদীর জলধারা পর্যন্ত যাবে, এমন ক্ষমতা দেহে তখন আর অবশিষ্ট ছিলো না।
হাটের প্রান্তে ছিলো একটি হড়ডিপল্লী। পল্লী বলতে সামান্য কয়েকটি পর্ণ কুটির মাত্র। ঐ কুটিরবাসীদের মধ্যে সম্ভবত কেউ তার আগমন লক্ষ্য করে থাকবে। এক সময় সে দেখলো, অদূরে কয়েকটি মানবমূর্তি দাঁড়িয়ে। একজন আবার প্রশ্নও করছে, মহাশয় আপনি কে? কি হেতু এ স্থানে আগমন, এই দশাই বা কেন?
আমাকে জল দিন, বসন্তদাসের মুখে ঐ একটি কথা তখন। প্রশ্নগুলি কর্ণে প্রবেশ করলেও কোনো উত্তরই তার মুখে আসছিলো না।
মহাশয় কি আমাদের হাতে জলপান করবেন?
বসন্তদাসের কাছে প্রশ্নটি ভয়ানক হাস্যকর বোধ হয়। ঐ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পুনরায় জল চায়। বলে, জল দিন ভ্রাতঃ, আমি তৃষ্ণার্ত, পরে কথা বলবেন।
এক বৃদ্ধ মৃৎপাত্রে জল এনে দিলে সে তা পান করে এবং স্বস্থ হয়। শেষে নিজ পরিচয় জানিয়ে সে তার উজুবট যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।
শুভ্রকেশ এক বৃদ্ধ ছিলেন ঐ স্থানে। তিনি বললেন, মহাশয়, উজুবট যাওয়া একেবারেই অর্থহীন, শুকদেব মহাশয়কে আমি জানি, অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি–তার সন্ধান করার জন্য আমরাও গিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকেই পাইনি–আপনিও পাবেন না–বরং এই আশঙ্কা যে, সামন্ত হরিসেনের গুপ্তচরদের হাতে বন্দী হয়ে যেতে পারেন।
হ্যাঁ মহাশয়, যাবেন না! অধিকতর বয়স্ক আরেকজন বললেন। পরামর্শ দিলেন, আপনি বরং নদীর এই পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতেই সন্ধান করে দেখুন।
বসন্তদাস লোকগুলির কথা শোনে এবং তার অদ্ভুত বোধ হয়। শেষে সে বলে, এ আপনারা কী বলছেন, আমার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না। মায়াবতী আমার স্ত্রী, আমার ধর্মপত্নী, অগ্নিসাক্ষ্য করে তাকে আমি বিবাহ করেছি। সে মৃত, না জীবিত, সে সংবাদ আমি নেব না? যদি মৃত হয়, তাহলে তার শেষকৃত্যেরও তো একটি প্রশ্ন আছে।
বৃদ্ধটি বসন্তদাসের কথা শুনে করুণ ও মলিন হাসি হাসেন। বলেন, মহাশয়, আমি পকূকেশ বৃদ্ধ, নিম্নজাতি, কিন্তু কেশগুলি আমার অহেতুক পাকেনি। সেই জন্যই বলছি, বুদ্ধিভ্রষ্ট হবেন না–এ বড় দুঃসময়–এখন স্থির এবং শান্তচিত্তে সমস্ত কাজে হাত দেওয়া উচিত। আপনি কিঞ্চিৎ স্বস্থ হয়ে বাস্তব অবস্থাটি চিন্তা করে দেখুন। আজ ষষ্ঠ দিবস, তায় গ্রীষ্মকাল, আপনি কি মনে করেন শৃগাল–কুক্কুর মৃতদেহগুলিকে অক্ষত রেখেছে? প্রকৃত ব্যাপার তো মহাশয় ললাটে, ললাটলিপি আর কে খণ্ডাতে পারে?
বসন্তদাসের মনেও যে ঐ প্রকার চিন্তা আসেনি তা নয়। সে অনুমান করতে পারে, উজুবটে গেলে হয়তো সে কাউকেই পাবে না, কিন্তু তথাপি সে অন্তরের হাহাকারটি প্রশমিত করতে পারছিলো না। তার কেবলি মনে হচ্ছিলো থেকে থেকে–আছে, জীবিত আছে মায়াবতী, লোকে যা–ই বলুক।