লীলাবতী মাথা কুটেছে পিতার পদপ্রান্তে। বলেছে, পিতা ও কাজ করবেন না। যদি করেন, তাহলে আমি আত্মঘাতিনী হবো।
শ্যামাঙ্গের তখন কিছুই করণীয় ছিলো না। একেবারেই নীরব থাকতো। লীলাবতী প্রশ্ন করতো, আমি কী করবো বলুন? বলুন, আমি কি সেই ঘাতকের গৃহে যাবো?
শ্যামাঙ্গ কোনো উত্তর দিতে পারতো না। তখন তীক্ষ্ণ শাণিত বিদ্রূপ আর অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত করতো সে শ্যামাঙ্গকে। বলতো, আপনি কেমন পুরুষ যে একটি রমণীর জীবিত থাকবার পথ করে দিতে পারেন না? তাহলে কেন ফিরে এসেছিলেন আপনি? বলুন, কোন আশা ছিলো আপনার মনে?
এই প্রকার তীব্র আক্রমণ প্রায় প্রতিরাত্রেই হতো। প্রতিরাত্রেই শ্যামাঙ্গ নীরব থাকতো। শেষে হরকান্তের মৃত্যু হলো এবং তখন থেকেই সে নীরব। আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ নেই তার কথায়–ক্ষোভ নেই, আক্রমণ নেই। সে অন্তঃপুরে সম্ভবত শীলনাথের গৃহিণীকে গৃহকর্মে সাহায্য করে। দিনান্তে বারেক কোনোদিন দেখা হয়, কোনোদিন তাও হয় না। দেখা হলে কেবল নির্বিকার দৃষ্টি বিনিময়টুকু হয়। যেন অপরিচিত লোক দেখছে সে।
শ্যামাঙ্গ জানে না, এই অপেক্ষার শেষ কখন। সে কার জন্য অপেক্ষা করছে, লীলাবতীর জন্য কি? লীলাবতী তাকে কী দেবে, যে তাকে অপেক্ষা করতে হবে? তার মনে প্রশ্ন জাগে একে একে। নাকি সে অরক্ষণীয়া এক রমণীর রক্ষকমাত্র? তার মাতুল এসে যাবে তারপর আর শ্যামাঙ্গের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। এই কি প্রকৃত অবস্থা তাহলে? পরস্পরের কাছে পরস্পরের কোনোই ভূমিকা নেই?
সে কিছুই বলতে পারে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ভবিষ্যতে প্রকাণ্ড একটি শূন্যতা ব্যতীত কিছু নেই। তার বলার কিছু নেই, করারও কিছু নেই।
সে ইদানীং প্রায় প্রতিদিনই দুচারটি করে পুত্তলি গড়ে। এবং প্রতিটি পুত্তলিতেই অবিকল লীলাবতী এসে ধরা দেয়। কোথাও লীলাবতী কক্ষে কলসটি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, কোথাও সে কেশ পরিচর্যায় রত, কোথাও বা মেষ শাবকটিকে ক্রোড়ে নিয়ে সে আদর করছে–এই প্রকার নানান ভঙ্গি পুত্তলিগুলিতে। এগুলি সে এখনও কাউকে দিতে পারেনি। রৌদ্রে শুষ্ক করা হয়েছে, এখন প্রজ্বলিত অঙ্গারে দগ্ধ করলেই ব্যবহারের উপযোগী হবে। এই জন্য সে নির্জন আম্রকাননের নিকটে একটি স্থানে অগ্নিকুণ্ড নির্মাণের আয়োজন করছিলো। কোথায় যে সংবাদ পেয়েছিলো বলা কঠিন, দ্বিপ্রহরে লীলাবতীকে সেই বিজন কাননে দেখা গেলো।
তাকে দেখে শ্যামাঙ্গ অবাক। বললো, তুমি?
হ্যাঁ, আমি এখানে অগ্নিকুণ্ড কেন?
কিছু পুত্তলি গড়েছি, সেগুলি পোড়াবো।
কিন্তু এভাবে অগ্নি জ্বালালে গৃহস্থ রুষ্ট হতে পারেন, সে কথা ভেবেছেন?
শ্যামাঙ্গের জানা ছিলো না যে, পল্লীপ্রান্তের আম্রকাননপার্শ্বে, প্রায় সকলের অগোচরে, একটি ক্ষুদ্র অগ্নিকুণ্ড জ্বালালেও তা অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে।
কাননভূমি নির্জন। লীলাবতী একটি পুত্তলি হাতে তুলে নিলো। দেখলো সেটি, অতঃপর সেটি রেখে পুনরায় অন্য একটি পুত্তলি তুলে নিলো, সেটিও দেখলো। সম্মুখেই শ্যামাঙ্গ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে–সেদিকেও বার দুয়েক দৃষ্টিপাত করলো। লীলাবতীর অবয়ব ফুটে রয়েছে পুত্তলিগুলিতে, সম্ভবত সেই কারণেই তার দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে প্রকাশ পাচ্ছিলো লজ্জা এবং অপরাধ বোধ। শ্যামাঙ্গকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার অন্তরাত্মা জ্বলে গেলো। বললো, কী দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
তুমি বড় কৃশা হয়েছে।
কেন, স্থূলা হলে উত্তম হতো? দেখতে আরও আকর্ষণীয়া হতাম? নতুন একটি পুত্তলি গড়তেন?
শ্যামাঙ্গ কিছু বললো না।
আচ্ছা আপনি এখানে কেন রয়েছেন, বলতে পারেন?
এবারও শ্যামাঙ্গ নীরব।
সে তখন রুক্ষকেশী কৃশা রমণী মূর্তিটির মধ্যে সন্ধান করছে সোমপুর বিহারে দেখা সেই যক্ষী মূর্তিটির সাদৃশ্য। কোথায় সেই প্রগল্ভা তরুণীটি যার হাস্যাননে সূর্যালোক চমকিত হতো? যার কথা শুনলে হৃদয় হতো উৎফুল্ল, সে তো সম্মুখে নেই। এমন বিষাদ, এমন নিঃস্বতা কি কোনো নীরব মুখভাবে সে দেখেছে কখনও? তার মনে পড়ে না।
শুনুন, আমি এখানে থাকবো না, হঠাৎ লীলাবতী জানায়।
কেন? কেন থাকবে না?
এখানে থাকা এবং ভাদ্রপাদের পথকুক্কুরী হওয়া একই কথা।
এ তুমি কি বলছো? শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় বোধ করে। জানতে চায়, শীলনাথ কিছু বলেছেন?
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি যোগব্রত নিয়েছি কিনা–আমাকে তাঁর সাধনসঙ্গিনী করতে চান। আগামী অমাবস্যায় শীনাথ যোগাচারে প্রবেশ করবেন।
শ্যামাঙ্গ যোগাচারের প্রক্রিয়া কী জানে না। তবে শুনেছে, নানান ক্রিয়াকাণ্ড থাকে ঐ আচারের অনুষ্ঠানাদিতে। নারী–সঙ্গের একটি কুৎসিত ব্যাপারও নাকি ঐ আচারের আবশ্যিক অঙ্গ। সে বললো, লীলা, এবার তোমাকে মনস্থির করতে হবে।
লীলা শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়।
শ্যামাঙ্গ বলে, আমি এযাবৎ কিছুই বলিনি। কেননা আমার বলবার কথা ছিলো না। তোমার পিতা ও মাতুল ছিলেন। আমি যদি কিছু বলতামও, তাহলে তা গ্রাহ্য হতো না আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা তুমিও করতে। ভাবতে, আমি লোভ ও বাসনার বশবর্তী হয়ে কথা বলছি। কিন্তু এখন তোমার পশ্চাতে কেউ নেই। এখন তুমি কেবল তোমার। সুতরাং সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। আমি তোমার পশ্চাতে পশ্চাতে বহুদূর চলে এসেছি। আমার আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে পুরুষ মানুষ বলে আমি হয়তো পথে পথেই থেকে যেতে পারি। তথাপি তোমার সিদ্ধান্তটি আমার জানা প্রয়োজন–কেননা সিদ্ধান্তটি হবে প্রকৃতপক্ষে আমাদের উভয়ের। আজ যদি সিদ্ধান্ত নিতে না পারি আমরা, তাহলে সে ব্যর্থতার দুর্ভার গ্লানি সমস্ত জীবন আমাদের বহন করতে হবে। আমি বলি, তুমি স্বামীর কাছে চলো, আমি নিয়ে যাই। সামাজিক জীবনে তুমি স্থিতা হবে, সংসারে তোমার স্থান হবে, সে এক পথ। নতুবা চলো, আমরা এ স্থান ত্যাগ করে দূর দেশে চলে যাই। আমরা দুজনে যদি একত্র জীবনযাপন করতে চাই তাহলে দূর দেশে গমন ব্যতিরেকে গত্যন্তর নেই–তুমি ভেবে দেখো, অমাবস্যার এখনও বিলম্ব আছে–