কিন্তু বিল্বগ্রামে উপস্থিত হয়ে সে আশা ত্যাগ করতে হলো। গুরু বসুদেব নেই, নীলাম্বরও নেই। সিদ্ধপা তাঁর এক শিষ্যের জ্ঞাতি সুভদ্ৰদাসের গৃহে আশ্রয় নিলেন। দুর্যোগের উপর দুর্যোগ, হরকান্ত বিল্বগ্রামেই দেহ ত্যাগ করলেন। উজুবটের সেই ভয়াবহ রাত্রিকালে তাঁর মস্তকে তরবারির আঘাত লেগেছিলো। ক্ষতটি নিরাময় হয়নি। প্রায়ই রক্তক্ষরণ হতো। শেষে ওই পরিণতি।
সামন্তপতির চর এখানেও উৎপাত আরম্ভ করলো। তারা প্রায়ই সংবাদ নিতে আসতো। যোগী পুরুষটি কে? কোন স্থান থেকে এদের আগমন? আর যুবাপুরুষটিই বা কেন এদের সঙ্গেইত্যাকার তাদের প্রশ্ন। সুভদ্রদাস বলতেন, যোগী পুরুষটি প্রকৃতপক্ষে যোগী নন–নিতান্তই দরিদ্র ভিক্ষাজীবী–তবে গতায়ু বৃদ্ধটি আমার মাতুল। মাতুলের সঙ্গেই যোগীটি এসেছেন। আর ঐ যুবাপুরুষটি মাতুলের ভ্রাতুষ্পুত্র।
ঐ কথা বলে তাদের বোঝানো গেলেও, সিদ্ধপা যেমন, তেমনি শ্যামাঙ্গও বুঝছিলো যে বিল্বগ্রাম তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সুধীমিত্র প্রজাপীড়ক না হলেও ঘোর বৈষ্ণব। ওদিকে পিপ্পলীহাট এবং উজুবটের কাহিনী দুটি ভিন্ন আকারে এ অঞ্চলে প্রচারিত হয়েছে। প্রচারণাটি এইরূপ যে, সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের প্ররোচনায় চণ্ডাল ডোম ও নিম্নশূদ্র ক্ষেত্রকররা দ্রোহ উত্থাপন করে গ্রামবাসীদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করেছিলো–পরম সৌভাগ্য যে মহাসামন্ত হরিসেন ও তাঁর অনুগামীরা ছিলেন সজাগ, ফলে ঐ দ্রোহ ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কাহিনীটি ঐরূপেই সকলের জানা। সুধীমিত্র ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি, ধর্মরক্ষার জন্য হেন কাজ নেই যা তিনি করেন না। ভিক্ষু যোগীদের তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তাঁর চর প্রায় সর্বত্রই। চণ্ডাল ডোম হড়ডিদের পল্লীগুলিতে তাঁর অনুচরেরা প্রায়ই ভ্রমণ করে। তেমন কোনো সন্দেহের কারণ ঘটলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শোনা যায়, ইতোমধ্যে তারা কয়েকজন ভিক্ষুকে বন্দী করে নিয়ে গেছে–ঐ বন্দীদের কী পরিণতি হয়েছে, তা কেউ জানে না।
এসব সংবাদ জ্ঞাত হবার পর ঐ স্থানে কে থাকতে পারে? তাই সিদ্ধপা ভাগিনেয়ীকে নিয়ে এসেছেন এই নবপাটক গ্রামে, শিষ্য শীলনাথের গৃহে। ধীবর ও জালিকদের বাস গ্রামটিতে, সুতরাং গ্রামটি সন্দেহের ঊর্ধ্বে। অন্তত সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের গমনাগমন যে ঐ গ্রামে নেই, এ বিষয়ে সামন্তপতির অনুচরেরা নাকি নিশ্চিত–এইরূপ একটি কথা পথিমধ্যেই সিদ্ধপা শুনেছিলেন। সুতরাং নবপাটক গ্রামে লীলাবতীরা দীর্ঘকালই অবস্থান করতে পারবে। সিদ্ধপা শ্যামাঙ্গকে বলেছেন, বৎস, তোমাকেও এই স্থানে থাকতে হবে কিছুকাল, যতোদিন না লীলাবতীর একটি সদ্ব্যবস্থা হচ্ছে।
ব্যবস্থা হয়েছে, লীলাবতী অন্তঃপুরে গৃহস্থের পত্নী কন্যাদের সঙ্গে থাকবে আর শ্যামাঙ্গের স্থান হবে বহির্বাটিতে। এই ব্যবস্থা করে সিদ্ধপা বিদায় নিয়েছেন। কোথায় গন্তব্য, কবে ফিরবেন, কিছুই বলে যাননি।
তবে সমস্যাও কিছু হয়নি। শীলনাথের পরিবারের সকলেই পরমাত্মীয় জ্ঞানে আতিথ্যদান করেছেন। শীলনাথ সম্পন্ন গৃহস্থ। একদিকে তার ক্ষেত্রকর্ম, অন্যদিকে জালিকবৃত্তি। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর উপার্জন যথেষ্ট। গৃহে কত যে দাসদাসী আত্মীয় পরিজন তা গণনা করা যায় না। শ্যামাঙ্গ কখনও কখনও ক্ষেত্র কর্মে সাহায্য করে। কখনও আবার জালিকদের সঙ্গে নৌকাযোগে মৎস্যাহরণে যায়। যখন কোথাও যায় না, তখন সে বসে বসে পুত্তলি নির্মাণ করে।
লীলাবতীর সঙ্গে কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়, কোনোদিন হয় না। তার পিতৃশোক এখনও প্রশমিত হয়নি। যদিও সে পিতৃশোকে অত্যধিক কাতর হয়েছিলো, এমন দেখা যায়নি। পিতার মৃত্যুর পর সে অধিকতর গম্ভীর হয়েছে। কথা বলে কম। তার এই নীরবতার আবরণটি আর কেউ অনুভব করতে পারে না, কেবল শ্যামাঙ্গ অনুভব করে। সে বুঝতে পারে, লীলাবতী এখন হাসে না–তার কথায় এখন বুদ্ধিদীপ্ত বিচ্ছুরণ নেই তার দুচোখের চঞ্চল দৃষ্টিতে পলকে পলকে যে নতুন আলোর চমক দেখা যেতো, সেটি আর দেখা যায় না।
জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যাবার পর সান্ত্বনার কি কিছু থাকে? শ্যামাঙ্গ মুখপানে দৃষ্টিপাত করলে সেও শ্যামাঙ্গের মুখপানে নিঃসঙ্কোচ দৃষ্টিপাত করে। কী দেখে, শ্যামাঙ্গ জানে না। তবে তার সম্ভবত কোনো প্রশ্ন আছে, এমন মনে হয়। সে জানতে চায়, কিছু বলবে লীলাবতী? লীলাবতী দক্ষিণে বামে মাথা দোলায়।
তোমার কি কথা বলতে ইচ্ছা করে না?
না, আর প্রয়োজনও কি আছে?
এ বড় কঠিন প্রশ্ন। প্রয়োজন কি আছে? সত্যিই তো, কোন প্রয়োজনের কথা সে বলবে? আর থাকলেও সে কথা শ্যামাঙ্গকে কেন বলবে?
উজুবট গ্রামে আক্রান্ত হওয়ার পর সে শ্যামাঙ্গকে হাতে ধরে কুটিরের বাইরে নিয়ে এসেছিলো। বলা যায়, শ্যামাঙ্গের প্রাণ সেদিন সে-ই রক্ষা করেছে।
সেদিনকার সেই প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা, ধূম্রকুণ্ডলী, আর্তচিৎকার ও নরহত্যার দৃশ্যগুলির মধ্যে সে লোকটিকে দেখেছিলো তার স্পষ্ট মনে আছে–ওই মুখ বিস্মৃত হওয়া যায় না। মার মার রবে ধাবমান লোকগুলির সঙ্গে ঘাতকরূপী অভিমন্যু দাস ছুটে এসেছিলো। সে জানে না, তার উত্তোলিত তরবারির আঘাতই পিতার মস্তকে এসে পতিত হয়েছিলো কিনা। মৃত্যুশয্যায় শায়িত পিতা বারবার বলেছেন, মা জামাতাকে সংবাদ দিই, সে আসুক, তোকে নিয়ে যাক।