মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে ক্ষুদ্র চত্বরটিতে আসন দেওয়া হয়। প্রসাদে উপচার ছিলো বহুবিধ। তবে কিছু মিষ্টান্ন এবং কয়েকটি ফল মাত্র গ্রহণ করে সে। দুগ্ধ ক্ষীরাদি স্পর্শ করে না।
মন্দিরদাসী দ্বারদেশে উপস্থিত ছিলো। বললো, আপনি বোধ হয় এরূপ আহারে অভ্যস্ত নন।
কি যে বলেন, এ তো রাজভোগেরও অধিক, বসন্ত নতমুখে জানায়।
এ আপনার বিনয় ভাষণ।
কেন, বিনয় ভাষণ কেন হবে! বসন্ত রমণীর মুখপানে সপ্রশ্ন দৃষ্টি তোলে।
গৃহী মানুষের রুচি কিরূপ তা আমি জানি–মনে রাখবেন, এ মন্দিরে যারা প্রতিদিন আসে, তারা প্রত্যেকেই গৃহী।
হতে পারে, বসন্তদাস জানায়। কিন্তু এখন তো আমি গৃহে নেই, পথে পথে দিনযাপন করি। আজ আমার পরম সৌভাগ্য যে দেবতার প্রসাদ পেলাম–কাল যে কী পাবো, তার কি নিশ্চয়তা আছে কিছু, বলুন? এ মন্দিরে কি কাল আমার অবস্থান সম্ভব হবে?
মন্দিরদাসী ঐ কথায় গম্ভীর হয়। কিছু বলে না, দূর আকাশে তার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে। ক্ষণকাল পরে সে ধীর কণ্ঠে বলে, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্য জানেন–বড় অনিশ্চিত আমাদের বর্তমান, আজো সামন্তপতির দুই অনুচর এসেছিলো মন্দিরে।
কেন, এখানে ওরা কী চায়? বসন্তদাস প্রশ্ন না করে পারে না।
কেন, জানেন না? মন্দিরদাসীর ওষ্ঠ প্রান্তে ঐ মুহূর্তে ক্ষীণ একটি শ্লেষের রেখা দেখা যায়। বলে, ওরা সদ্ধর্মীদের চায়, নাথযোগীদের চায়, সূর্যোপাসকদের চায়–প্রত্যেককেই ওদের সন্দেহ।
বসন্তদাসের মস্তিষ্কে হঠাৎ একটি নতুন চিন্তার উদয় হয়। সে বলে, মন্দির প্রাচীন হলেই ওদের সন্দেহ হয়–কেন, বলতে পারেন?
মন্দিরদাসীর মুখে পুনরায় ক্ষীণ হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, জানি না, হয়তো প্রাকৃতজন ওদের ভয়ের কারণ–প্রাচীন মন্দিরগুলিই তো প্রাকৃতজনের সঙ্গে যুক্ত, বিষ্ণুমন্দির তো সেদিনকার ঘটনা–বৈষ্ণব আর কয়জন?
ব্যাখ্যাটি একেবারে অযৌক্তিক মনে হয় না। নতুবা প্রাচীন মন্দিরগুলিকে কেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে? দেবীকোটের বজ্রতারা মন্দির, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দির, এবং কদম্বঘাটের এই সূর্যদেবতার মন্দির–এই তিনটি মন্দিরই প্রাচীন এবং এই প্রাচীন মন্দিরগুলিই একেকটি গোপন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র–অন্তত সামন্তপতি এবং রাজপুরুষেরা এইরূপই প্রচার করছে। এখন বোঝা যায়, কেবল সদ্ধর্মীরাই তাদের সন্দেহের পাত্র নয়। তারা সূর্যোপাসকদের সন্দেহ করছে, নাথযোগীদের সন্দেহ করছে, ব্রাত্যশ্রেণীর ডোম চণ্ডালদের সন্দেহ করছে–সন্দেহের আর শেষে নেই।
একটা কথা চিন্তা করেছেন? আচমন শেষে বসন্তদাস বলে।
কী কথা? মন্দিরদাসী সাগ্রহে অতিথির মুখপানে চায়।
যাদের ওরা সন্দেহ করে, সেই সন্দেহের পাত্ররা সকলে যদি একত্রিত হয়? যদি কোনো কারণে নির্যাতিত মানুষের অপমান–জ্বালা–বেদনা–হাহাকার–ক্রোধ–হিংস্রতা সমস্তই একত্রিত হয়ে বিস্ফোরিত হয়? তাহলে সামন্ত মহাসামন্ত রাজপুরুষদের ভবিষ্যৎ কী হবে?
চুপ, বলবেন না–আর বলবেন না।
বসন্তদাস দেখে মন্দিরদাসীর মুখভাবে শঙ্কা ও ত্রাসের ছায়া। সে প্রায় গোপন স্বরে জানায়, সাবধান, অমন কথা ভ্রান্তিবশতও মুখে আনবেন না।
বিদায়কালে মন্দিরদাসী বললো, আপনার পরিচয় কিন্তু জানা হলো না।
তার কি আর প্রয়োজন আছে? বসন্তদাস হাসে।
ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? মন্দিরদাসীর মুখভাবে বিষাদের ছায়া নামে। বলে, যে দুষ্কালের মধ্যে আমরা পতিত হয়েছি, তাতে কিছুই বলা যায় না–এই হীনা মন্দিরদাসীরও আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে–অবশ্য নিজ পরিচয় যদি আপনি গোপন রাখতে চান, তাহলে ভিন্ন কথা–
ঐ উক্তির পর নিজের পরিচয়দানে কুণ্ঠাবোধ থাকার কথা নয়। বসন্তদাসেরও রইলো না। সে জানালো, অধমের নাম বসন্তদাস, নিবাস আত্রেয়ী–তীরের আম্রপট্টলী– রজতপট অঞ্চলে, পিতা ক্ষেত্রকর্ম করেন, তাঁর নাম–
থাক হয়েছে, মন্দিরদাসী ছায়ার জন্য ঐটুকুই যথেষ্ট।
বসন্তদাস রমণীটির বাকপটুতায় চমকিত হয়। নাম জানতে পেরে সে ঈষৎ হাসেও। বলে, আপনি তাহলে ছায়া–কিন্তু কিসের ছায়া?
কেন, ছায়ার বঙ্কিম ভ্রূধনুতে চকিতে শর যোজিত হয়। বলে, সূর্যের ছায়া, সূর্যদেব ব্যতীত ছায়া সৃষ্টি আর কে করতে পারে, বলুন?
ছায়ার হাসি শতধারে বিচ্ছুরিত হয় ঐ কথার পর। কিন্তু বসন্তদাস হাসিতে যোগ দিতে পারে না। এ কি কৌতুক? তার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রত্যয় হতে চায় না যে ঐ ভ্রূভঙ্গী, ঐ হাস্যধারা, ঐ ভাষা, নিতান্তই কৌতুক সৃষ্টির কারণে।
অবশেষে ছায়া জানায়, আপনি যদি এ অঞ্চলে দিবস দুই অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে আশা করি, কোনো না কোনো সংবাদ অবশ্যই জানাতে পারবো।
আর হ্যাঁ, ছায়ার চক্ষু দুটিতে পুনরায় বিদ্যুৎ চমকিত হয়। বলে, আপনার রাত্রিযাপনের সমস্যা হলে স্মরণ রাখবেন, এ মন্দিরের দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।
এ কি আমন্ত্রণ! বসন্তদাসের বিশ্বাস হতে চায় না। মন্দিরদাসীরা কি সর্বত্রই তাকে কণ্ঠলগ্ন করার জন্য উদ্বাহু হয়ে আছে? এ কি সম্ভব? সে মনের গোপনে একটি মধুর বিভ্রান্তি নিয়ে মন্দির ত্যাগ করে।
০৫. প্রথমে বনভূমি, তারপর বিস্তীর্ণ জলাশয়
প্রথমে বনভূমি, তারপর বিস্তীর্ণ জলাশয়, তারই পাশে নতুন গ্রাম নবপাটক। এই গ্রামে লীলাবতীরা আশ্রয় নিয়েছে–এখানে নিয়ে এসেছেন মাতুল সিদ্ধপা। মধ্যপথে তারা অবস্থান করেছিলো বিল্বগ্রামে। উজুবট থেকে পলায়ন করে তারা প্রথমে বনভূমিতে প্রবেশ করে। সেখানে দিন দুই অপেক্ষা করে এই আশায়, যে নিজ গ্রামে ফিরতে পারবে। কিন্তু যখন জানা গেলো যে হরিসেনের অনুচরদল একজন যোগী, হরকান্ত এবং এক কুম্ভকারের অনুসন্ধান করছে, তখন তারা গ্রামে যাওয়ার আশা ত্যাগ করে উপনীত হলো কদম্বঘাটে। ঐ স্থানের সূর্যমন্দিরে দিন দুই অবস্থান করে তারা। হয়তো আরও কদিন থাকতো, কিন্তু জনাকয় রাজার চর এমন উপদ্রব আরম্ভ করলো যে সে স্থানে তিষ্ঠানো অসম্ভব হয়ে উঠলো। সে স্থান থেকে শ্যামাঙ্গ তাদের নিয়ে যায় বিশ্বগ্রামে। তার আশা ছিলো, গুরু বসুদেব আছেন, মিত্র নীলাম্বর আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দুর্গত পরিবারটির জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। সর্বাপেক্ষা বড় আশা ছিলো এই যে, গুরু বসুদেব অন্তত সুধীমিত্রকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, হরকান্ত বা সিদ্ধপা আর যাই হোন, ষড়যন্ত্রকারী নন।