দীর্ঘ আলাপ, বসন্তদাস ক্রমে সহজ হয়ে উঠলো। কথা বললো নানান প্রসঙ্গে। শেষে উঠলো, আমি এবার যাই।
সে কি, কোথায় যাবেন? দ্বিপ্রহরের তো বিলম্ব নেই, মন্দিরের প্রসাদ আছে, আহারাদি সম্পন্ন এখানেই করুন।
বসন্তদাস রীতিমতো সঙ্কোচ বোধ করে। এতো অল্প সময়ের পরিচয়–এই পরিচয়ে কি আতিথ্য গ্রহণ করা উচিত? সে সবিনয়ে মস্তক আনত করে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছিলো। ঐ সময় যেন নারী কন্ঠে আদেশ শুনলো। হ্যাঁ আদেশই বলতে হবে। দ্বারে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে রমণীটি। বলছে, আপনি মন্দিরে প্রবেশ করে দেবতাকে অপমান করতে চান?
অপমান! কী বলে এই উন্মাদিনী? সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চায়।
নিশ্চয়ই অপমান! মন্দিরদাসীর কণ্ঠে যেন ক্রোধ শাণিত হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ স্বরে সে বলে, পূজার প্রসাদ প্রত্যাখ্যান কি দেবতার অপমান নয়?
বসন্তদাস অনুধাবন করার চেষ্টা করে, সত্যই কি তার আচরণে কোনো অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে? মন্দিরদাসীর মুখপানে দৃষ্টি তোলে সে এবং বিভ্রান্ত বোধ করে। কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেলেও রমণীর চক্ষু দুটিতে ক্রোধ কোথায়? বরং দেখতে পায় সেখানে কৌতুকের অস্পষ্ট একটি আভা কম্পমান।
যাক, তবে এ কৌতুক, অন্য কিছু নয়–স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বসন্তদাস। তার ভয় হচ্ছিলো। না জানি কী করে বসে রহস্যময়ী এই মন্দিরদাসী। সে কৃতাঞ্জলি হয়ে বিনয়সহকারে জানালো, উত্তম কথা ভদ্রে, আমি আপনার কথামতোই কাজ করবো।
এখানেই আপনি বিশ্রাম নিন। আদেশটি উচ্চারণ করে রমণীটি তৎক্ষণাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দ্বার পথে অন্তর্হিত হয়।
মন্দিরের গর্ভগৃহটি অন্ধকার। সেখানে দিবানিশি প্রদীপ জ্বলে, কিন্তু বাহিরের অংশে প্রদীপের প্রয়োজন হয় না। মন্দিরচূড়ার গঠন কৌশলে সম্ভবত কোনো ব্যবস্থা করা আছে যাতে বাইরের আলোক মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। বসন্তদাস একটি স্তম্ভে পৃষ্ঠদেশ এলায়িত করে বসে ছিলো। ঐ সময় মন্দির গাত্রের একটি চিত্রণ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের ধাতুমূর্তিটির গঠন কিরূপ তা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে অনুমান, সপ্তাশ্ববাহী রথে আকাশমণ্ডল পরিক্রমণরত সূর্যদেবের মূর্তিটিই এই মন্দিরের বিগ্রহ। কিন্তু মন্দির গাত্রে এ কিরূপ অলংকরণ? তার বিস্ময় জাগে। একদিকে একটি বৃক্ষ অপরদিকে সকিরণ সূর্য, সেই সঙ্গে একটি সর্প বৃক্ষের কাণ্ডটি বেষ্টন করে আছে। বৃক্ষ, সূর্য এবং সর্পের এমন একত্র যোজনা তো সে পূর্বে কোথাও দেখেনি! সে মন্দির গাত্রে হাত রাখে–অসম্ভব শীতল বোধ হয়। তার মনে হয়, কাল যেন সংহত শিলীভূত ও স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে এই স্থানে। তার স্মরণ হয়, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দিরটির গাত্রেও এইরূপই শীতলতা অনুভব করেছিলো সে।
অংশুমান নিকটে এলে সে জিজ্ঞাসা করে, ভ্রাতঃ, মন্দির গাত্রে এ কিরূপ চিত্ৰণ? এমন চিত্ৰণ তো আমি অন্য কোথাও দেখিনি।
অংশুমান চিত্রণের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে, মহাশয়, এর ব্যাখ্যা আমরাও জানি না। তবে পুরোহিত বলেন যে, বহু প্রাচীনকালে সূর্যদেব এইরূপেই পূজিত হতেন–আমি শুধু এইটুকু জানি যে, এই মন্দির বহু প্রাচীন–এর অধিক আমি আর কিছু বলতে পারবো না।
মন্দিরদাসী কখনও সম্মুখে আসছিলো, কখনও অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো না যে বসন্তদাসের উপস্থিতি সম্পর্কে সে সচেতন। মন্দিরপ্রাঙ্গণে ইতোমধ্যে কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠের আলাপ শুনতে পেয়েছে সে। একবার মনে হচ্ছিলো, মন্দিরদাসী যেন কাউকে তিরস্কার করছে। কাদের সঙ্গে ঐ বাদানুবাদ সে কিছু অনুমান করতে পারেনি। সে কৌতূহলী মনকে শাসন করেছে। নিজেকেই ডেকে বলেছে, ওহে বসন্তদাস, অধিক কৌতূহলী হয়ো না, নিজের চক্রে অগ্রে তৈলদান করো, পরে অন্যের কথা চিন্তা করতে যেও।
বাহিরে রৌদ্রদগ্ধ প্রাঙ্গণে বৃক্ষছায়া কাণ্ডের নিকটবর্তী হয়ে আসছিলো। বোঝা যাচ্ছিলো দ্বিপ্রহরের আর বিলম্ব নেই। বাহিরে যে বাদানুবাদ শোনা যাচ্ছিলো, এখন আর তা নেই। বসন্তদাসের চিন্তা হচ্ছিলো, অতঃপর মন্দির ত্যাগ করে কোন পথে গমন তার কর্তব্য? সে কি বিল্বগ্রামের দিকে যাবে, নাকি যাবে সুনন্দপুরের দিকে? একটি সূত্র তার। জানা প্রয়োজন। মন্দিরদাসীর কাছ থেকে শোনা সংবাদটি তাকে আশান্বিত করে তুলেছে। পক্ষকাল পূর্বে এ মন্দিরে এক যোগী পুরুষের সঙ্গে যে রমণী ও পুরুষ দুটি এসেছিলো, তারা যদি কোনো আক্রান্ত গ্রাম থেকে পলায়ন করে থাকে, তাহলে ওদের পক্ষেই শুকদেব ও মায়াবতীদের সংবাদ জানা সম্ভব। তার ধারণা, এই অঞ্চলেই কোথাও শুকদেব ও মায়াবতীরা আছে।
ঐ সময় মন্দিরের দাসী ক্ষণে ক্ষণে চত্বরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো এবং আসছিলো। কেন, সেই জানে। তবে চক্ষুতে চক্ষুতে মিলন হলেই অতীব রহস্যময় হাসি ফুটছিলো তার ওষ্ঠপ্রান্তে।
বসন্তদাসের মনে হচ্ছিলো, বালিগ্রামের কৃষ্ণার চাইতেও অধিক রহস্যময়ী এই মন্দিরসেবিকাটি। কেন যে সে এভাবে তাকে আতিথ্য গ্রহণে বাধ্য করলো, তার ধারণায় আসে না। তবে হ্যাঁ, একটি বিষয়ে সে নিশ্চিত, তীব্র আকর্ষণ এই রূপসী নারীর। যদি সে প্রগলভা হয়ে বারেক আহ্বান করে, তাহলে যে কী হবে, সে চিন্তা করতে পারে না। কারণ পুরুষের সংযমী থাকার ক্ষমতা কতটুকু সে তো তার উত্তম রূপে জানা।