তারা আরও কিছু বলাবলি করে, কিন্তু সেদিকে মনোযোগী হবার আর অবকাশ ছিলো না। কারণ নৌকাটি ঐ মুহূর্তেই ভূমিস্পর্শ করেছে। বসন্তদাস পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিটির কাছে জানতে চাইলো, বিল্বগ্রামের পথ কোনদিকে, বলবেন?
আহা দণ্ডকাল পূর্বে এলে তো শকটারোহণে যেতে পারতেন, লোকটি জানায়। বলে, পথ খুবই সহজ, এই পথই গোহালিহাট হয়ে বিশ্বগ্রামে গেছে।
মহাশয়, মনে হচ্ছে, নতুন এসেছেন এদিকে?
লোকটির কৌতূহল নিবৃত্ত করে বসন্তদাস। বলে, হ্যাঁ, নতুনই বলতে পারেন।
ক্ষণকাল পরে ঐ লোকটির কাছেই সে জানতে চাইলো, এখানে পান্থশালা নেই?
আজ্ঞে না, পান্থশালা নেই, তবে ঐ যে মন্দির দেখতে পাচ্ছেন, লোকটি হাত তুলে দেখায়, ওখানে যান, দূরের যাত্রীরা ওখানেই রাত্রিযাপন করে।
মন্দিরে তখন ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। সেখানে জনসমাগমও হয়েছে দেখলো। সে মন্দিরের দিকেই অগ্রসর হলো।
একেবারে নিকটে নয় মন্দিরটি। পদব্রজে যেতে সময় লাগে। যখন উপস্থিত হলো, তখন আরতি চলছে। ভক্তরা চত্বরে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে।
সেও দুই কর যুক্ত করে প্রথমে বিগ্রহের উদ্দেশে প্রণাম জানালো, তারপর অন্যদের মতো করযুগল যুক্ত করে দাঁড়ালো। সংক্ষিপ্ত আরতি, অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রসাদ বিতরণ আরম্ভ হয়ে যায়। তাতে বালক-বালিকারা প্রসাদ সংগ্রহের জন্য হয়ে ওঠে তৎপর। ফলে চাঞ্চল্য জাগে ক্ষণেকের জন্য।
প্রসাদ বিতরণ করছিলো একজন তরুণ এবং একজন যুবতী। তারা সম্ভবত মন্দিরের সেবক এবং সেবিকা। সেবিকাটি অপরূপ সুন্দরী। মস্তকোপরি অবগুণ্ঠন ছিলো, তথাপি উত্তোলিত হাত দুখানি ব্যস্ত থাকায় প্রভাতকালের বায়ুতাড়না তাকে বিস্ৰস্তবাসা করে দিলো। এবং ঐ মুহূর্তটিতে যা দৃষ্টিগোচর হলো তা যে কোনো পুরুষ মানুষকে আমূল চঞ্চল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। বলাবাহুল্য, এমন রূপ–যৌবন কদাচিৎ দেখা যায়। কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে গেলো বসন্তদাসের। ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে দুই পা পশ্চাতে ফিরলো। এবং ক্ষুদ্র জনসমাবেশটি থেকে কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়ালো।
ভক্ত এবং প্রসাদ প্রার্থীরা একে একে সকলেই বিদায় হলো। বসন্তদাস দুএকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তারা কেউ-ই তার প্রতি মনোযোগী হয়নি। মন্দিরের সেবিকাটি সম্ভবত বসন্তদাসকে দেখে থাকবে। সে মন্দিরের দ্বারান্তরাল থেকে মন্দিরসেবক বালকটিকে ডেকে বললো, দেখো তো অংশুমান, লোকটি কি চায়?
মন্দিরটি সূর্যদেবতার। বিগ্রহটি ক্ষুদ্র কিন্তু ধাতু নির্মিত, প্রদীপের আলোকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। তরুণটি নিকটে এলে বসন্তদাস পুরোহিতের সন্ধান করলো। তাতে জানলো, পুরোহিত মন্দিরে থাকেন না, পূজা শেষে স্বগৃহে গমন করেন। স্বল্প পূর্বে যে বৃদ্ধটি চলে গেলেন, বসন্তদাস বুঝলো, তিনিই পুরোহিত। সন্ধ্যাকালে পুনরায় আসবেন। তখন সাক্ষাৎ হতে পারে।
মন্দিরের সেবিকা তখনও দ্বারান্তরালে এবং কৌতূহলী। অনুচ্চ কণ্ঠে জানতে চাইলো, আপনার কি বিশেষ প্রয়োজন? বৃদ্ধ মানুষ, সন্ধ্যাকালে নাও আসতে পারেন, তাহলে আপনাকে তাঁর গৃহে যেতে হবে।
বসন্তদাস চারিদিকে দৃষ্টিপাত করছিলো। এদেশে সূর্যদেবতার পূজা হয় জানে, কিন্তু মন্দির এই প্রথম দেখলো। এতদঞ্চলে সম্ভবত এই একটিই মন্দির। প্রাচীনতার চিহ্ন মন্দির গাত্রের প্রায় সর্বত্রই প্রকট। এইরূপ প্রায় অযত্নরক্ষিত মন্দিরেও সেবাদাসী রয়েছে দেখে সে অবাক হচ্ছিলো। দাসীটি সপ্রতিভ ভঙ্গীতে তখনও দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বসন্তদাস জানালো, ভদ্রে, আমি কতিপয় আত্মীয়ের সন্ধান করছি, তারা একটি যবন উপদ্রুত গ্রাম থেকে পলায়ন করে এসেছেন–এই গ্রাম বা নিকটবর্তী কোনো গ্রামে, ঐ প্রকার পলায়নপর লোকেদের আগমনের সংবাদ কি আপনার জানা আছে?
দাসীটি দ্বারান্তরাল থেকে এবার বাইরে এলো। বললো, না জানা নেই তেমন লোকের সংবাদ–কিন্তু যবনরা কি সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন আরম্ভ করে দিয়েছে?
মনে হলো, সেবিকাটি একেবারে অন্তঃপুরবাসিনী নয়। জগৎ সংসারের বহুবিধ বিষয় তার জানা। সে বললো, আপনি বরং মন্দিরের ভিতরে এসে কথা বলুন। মন্দির বলেই ভাববেন না যে এ স্থান নিরাপদ। এ স্থানেও গূঢ়পুরুষদের দৃষ্টি আছে।
কি অদ্ভুত কথা। সে বিস্ময় মানে, এই দেবমন্দিরের উপরও কেন দৃষ্টি রাখবে গূঢ়পুরুষেরা!
যুবতীটির মুখপানে দৃষ্টিপাত করা যায় না। বসন্তদাসের দৃষ্টি বার বার নত হয়ে আসছিলো। দৃষ্টি যে লগ্ন হয়ে থাকতে চায় ওষ্ঠদ্বয়ে, গ্রীবাদেশে, বক্ষে। এ তো বড় যন্ত্রণা। কৃষ্ণাকে দেখে তো এমন মনে হয়নি। সে নিদারুণ ব্ৰিত বোধ করে। সেবিকাটি তখনও বলছিলো, ক্রোশ দুই দূরে বিল্বগ্রাম। সেখানে সামন্ত সুধীমিত্র একটি বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করছেন। তার ধারণা, ঐ মন্দিরই হবে এতদঞ্চলের ধর্মীয় পীঠস্থান। তিনি মনে করেন, আমরা সূর্যোপাসকরা অন্তরে সদ্ধর্মী–সূর্যদেবতার পূজা করলেও। এবং এই মন্দির নাকি সদ্ধর্মীদের মিলিত হবার গোপন স্থান। এই সন্দেহের কথাটি তিনি প্রচারও করছেন।
মন্দিরদাসী আরও সংবাদ জানে। বললো, কেবল আপনাদের গ্রামেই নয়–আরও কয়েকটি গ্রামে ঐ প্রকার কাণ্ড ঘটেছে।
পূর্বে প্রতি পক্ষকালে দু’দশজন ভিক্ষু এসে এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করতো, এখন তারা কেউ আসে না। পক্ষকাল পূর্বে এক যোগীর সঙ্গে দুটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করে গেছে–পরিচয় জানায়নি। তবে আমার সন্দেহ, তারা কোনো আক্রান্ত গ্রামের লোক।