বসন্তদাস ভিক্ষু তিনটিকে লক্ষ্য করে দেখলো। কেশশ্মশ্রুহীন গোলাকার শান্ত সৌম্য মুখ। কোনো প্রতিক্রিয়াই সে মুখে আভাসিত হয় না। তার দুর্বোধ্য লাগে। আবার কেমন সন্দেহও হয়, তবে কি মিত্রানন্দ আর তার সঙ্গীরা একরূপ চিন্তা করে এবং এরা অন্য চিন্তা করে? মিত্রানন্দের সঙ্গে এরা যে সম্পর্কবিহীন তা–ও নয়। যদি মিত্রানন্দের। সেই কথা সত্য হয় যে, যবনদের সঙ্গে সদ্ধর্মীদের কী সম্পর্ক হবে তা এখনও স্থির হয়নি, তাহলে এই ভিক্ষুরা কীভাবে যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়? সে জানতে চাইলো, সকল সদ্ধর্মীর সম্মতিক্রমে কি আপনি যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন?
এই প্রশ্নে তিনজনই গম্ভীর হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি বলেন, এতে সম্মতির কি প্রয়োজন? এতো সংঘের কাজ নয়, একেবারেই দৈনন্দিন ধর্মের কাজ। শুধু বলবো, জীবে দয়া করো এই কাজের জন্য কারও সম্মতি প্রয়োজন নেই।
বসন্তদাসের অনুমান হয় মিত্রানন্দের প্রচেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি, তাদের সংঘ এখনও সংগঠিত নয়। কোনো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নেই, ভিক্ষুরা স্বেচ্ছাচারীর মতো আচরণ করছে। সে কৌতূহল বশত পুনরশি জিজ্ঞাসা করে, মহাশয়, যবন সেনাপতির নিকট না গিয়ে ঐ একই আবেদন কি রাজ পুরুষদের কাছে করা যেতো না?
এবার বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি হাসেন। বলেন, না ভ্রাতঃ, তা করা যেতো না–প্রথমত আমাকে রাজার সমীপে যেতে দেওয়া হতো না। এবং দ্বিতীয়ত যদি কোনোক্রমে যেতামও, তাহলেও কেউ আমার আবেদন শুনতো না।
কেন, শুনতো না কেন? বসন্তদাস জানতে চাইলো।
মিত্র, আপনি দেখছি নিতান্তই বালসুলভ প্রশ্ন করছেন। জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু বললেন, চিন্তা করে দেখুন, আমার আবেদন ওঁরা কেন শুনবেন? তাতে কারও কোনো লাভ নেই। রাজসভার লোকেরা প্রায় প্রত্যেকেই সামন্ত মহাসামন্ত, নিজ শ্রেণীর বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কথা তারা রাজসভায় উত্থাপিত হতে দেবেন না, এ তো সহজ কথা।
রাজসভায় তো মহারাজও থাকেন, তিনিই তো সর্বেসর্বাবসন্তদাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, মহারাজ অবশ্যই থাকেন। কিন্তু রাজার নিজস্ব শক্তি আর কতোটুকু–অশীতিপর বৃদ্ধ আমাদের রাজা। সামন্তপতিদের শক্তিতেই রাজার শক্তি। কেউ কি স্বেচ্ছায় নিজ হস্ত ছেদন করে, বলুন?
না, তা করে না, বসন্তদাস স্বীকার করে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কি চিন্তা করে না মানুষ? সে জানতে চাইলো।
অবশ্যই করে, ভিক্ষুটি বললেন, কিন্তু সে তো সুস্থ মানুষ। দেহ মনে সুস্থ মানুষ অবশ্যই ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কিন্তু তেমন সুস্থ মানুষ রাজসভায় আর কয়জন? রাজসভা অর্থ ও ক্ষমতার পীঠস্থান আর দুই–এরই প্রবণতা হচ্ছে কালক্রমে স্বয়ং–বিকৃত হওয়া। প্রায় দ্বিশতাধিক বর্ষের রাজসভা, মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালই প্রায় অশীতিবর্ষ। এমতাবস্থায় সভার প্রায় সকল লোকই যে বিকারগ্রস্ত হবে এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। আর সেই বিকারগ্রস্তদের মানসচক্ষু কি স্বচ্ছ, বলুন? যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ কি তাদের পক্ষে সম্ভব? এরা অচিরেই ধ্বংস হবে দেখবেন। কেউ এদের রক্ষা করতে পারবে না।
যেন জটিল একটি বিতর্ক ক্রমেই প্রসারিত ও দীর্ঘ হয়ে চলেছে। বসন্তদাস বললো, শুনুন মহাশয়, আমি অতো কথা জানি না, মহারাজ লক্ষ্মণ সেন, তাঁর রাজসভা, কিংবা তার সামন্তবর্গ, এরা রক্ষা পাবে কি পাবে না, এ বিষয়ে আমার সামান্যতম শিরোবেদনা নেই। জানি, স্বকৃত পাপই এদের ধ্বংস করবে। আমার চিন্তার বিষয় বহিরাগত যবনেরা। এরা একেবারেই বহির্দেশীয় এবং ধর্মে ভিন্ন, আচারে ভিন্ন, ভাষায় ভিন্ন–এরা যে কী করবে, কেউ জানে না।
ভিক্ষুরা বসন্তদাসের কথা শুনে অনেকক্ষণ নীরব রইলো। শেষে জ্যেষ্ঠভিক্ষু বললেন, আপনার কথাটি আমাদের মনে থাকবে–ভিক্ষু মিত্রানন্দের মুখেও আমরা এইরূপ কথা শুনেছি–দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়–তথাগতের কী ইচ্ছা।
রাত্রি শেষে প্রত্যুষকালে ভিক্ষুরা প্রস্থান করলে বসন্তদাসও নদী অতিক্রমের আশায় পূর্বাভিমুখে যাত্রা করে।
০৪. নদী এ স্থানে অগভীর
নদী এ স্থানে অগভীর। উজুবট থেকে স্থানটি ক্রোশ চারেক উত্তরে। নদীবক্ষে স্থানে স্থানে বালুকাস্তূপ। নৌকাটি পরপারে উপনীত হতে সময় নেয়। নৌকার অন্যান্য আরোহীদের আলাপ শ্রবণে অনুমান হয় নদীর পূর্বতীরে গোহালিহাট, বিল্বগ্রাম, সুনন্দপুর ইত্যাদি গ্রাম জনপদগুলি পরস্পর নিকটবর্তী। পরপারের কদম্বঘাট থেকে ঐ সকল গ্রামের দিকে যাওয়ার সুব্যবস্থাও নাকি আছে। প্রায় প্রতিদিনই দুএকখানি গো অথবা মহিষ শকট ঐ সকল গ্রামে যায়।
বসন্তদাসের গন্তব্য স্থির নয়। নদীতীরে সংবাদাদি নিয়ে তবে নিজ গন্তব্য স্থির করতে হবে।
নৌযানটি যখন তীরবর্তী হলো তখন সকাল। সবে সূর্যোদয় হয়েছে। নদীবক্ষে বীচিমালার শীর্ষে শীর্ষে নবীন সূর্যালোক এমত ঝলকিত হচ্ছে যে সেদিকে দৃষ্টি রাখা যায় না। রাখলে নয়ন ধাঁধে। নদীজলে কয়েকজন স্নানার্থী ছিলো, তাদের একজন সূর্যস্তর সমাপন করে একজন নৌকারোহীকে ডেকে বললো, ওহে পীতাম্বর, তুমি এতো বিলম্ব করলে কেন, তোমার শ্যলিকাটির অবস্থা ওদিকে এখন–তখন, শীঘ গৃহে যাও।
পীতাম্বর কিছু বলে না, সে অধোমুখে থাকে। তার বন্ধুটি মৃদু ভৎর্সনা করে বলে, এ তোমার উচিত হয়নি, ছি ছি!