কুটির ত্যাগ করে সে অগ্রসর হলো। মন ভারাক্রান্ত। অনিত্য মানব জীবনের কথা বারংবার মনে উদিত হচ্ছে। এই জীবনের কি কোনো অর্থ আছে? জীবন যদি এই প্রকার অজ্ঞাতে, অগোচরে, মৃত্যুতে সমর্পিত হয়, তাহলে সংসার কেন? পুত্র কলত্রেরই বা কি। প্রয়োজন?
সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। মেলায় এখন জনপ্রাণী নেই। সামান্য পথ অতিক্রম করেছে, এমন সময় দেখলো, দুটি শ্মশান শৃগাল অগ্রসর হয়ে আসছে।
শৃগাল দুটি দেখে সে দাঁড়ায়। তার স্পষ্ট অনুমান হয়, বৃদ্ধের দেহ এখন শৃগাল দুটির উপাদেয় ভক্ষ্য হবে।
যবন বৃদ্ধের মৃতদেহের পরিণাম অনুমান করে সে আর পদক্ষেপণ করতে পারলো। সৌম্য সুন্দর মুখখানি, কোমল মমতাময় হাতের অঙ্গুলিগুলি, শ্বেত শুভ্র কেশভার– সমস্তই এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে শৃগাল দুটির দ্রংষ্ট্রাঘাতে। দৃশ্যটি কল্পনায় আসা মাত্র সে ফিরলো।
সে জানে না, যাবনী ধর্মে শেষকৃত্যের বিধান কী। শুনেছিলো যে যবনেরা মৃতের দাহ করে না, সমাধি দেয়। কিন্তু কি মন্ত্র, কোন দেবতাকেই বা আহ্বান করা হয়, কিছুই তার জানা নেই। কিন্তু হতোদ্যম হলো না সে। পান্থশালাতেই পাওয়া গেলো খনিত্র খানি। সে কালবিলম্ব না করে খনন আরম্ভ করে দিলো।
পিঙ্গল পশ্চিমাকাশে তখন বঙ্কিম চন্দ্রটি উদিত হয়েছে, পরিত্যক্ত জনহীন মেলায় একটি ভৌতিক ভাব, দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সম্ভবত যজ্ঞানুষ্ঠান করে মারী–ভয় দূর করার চেষ্টা করছে পল্লীবাসীরা। দুটি কুকুরের ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেলো অদূরে। বসন্তদাসের খনন যখন সমাপ্ত হলো তখন রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।
অতিশয় ক্লান্ত সে তখন। দেহ আর চলে না। পান্থশালা থেকে মৃতদেহটি বহন করে আনার সময় দুবার তার পদস্খলন হয়। তথাপি কাজটি করে সে। মৃতদেহটি সমাধিগর্ভে নিক্ষেপ করে দেখে, নিক্ষেপ যথাযথ হয়নি। ঊর্ধ্বাঙ্গ সমাধিগর্ভে গেলেও পদযুগল রয়েছে বাইরে। তখন আবার নামতে হয় সমাধিগর্ভে। দেহটিকে লম্বমান করে শায়িত করতে হয়। ঐ সময় সে আবিষ্কার করে বৃদ্ধের কটিবন্ধটি স্কুল এবং কঠিন, সম্ভবত সেখানে কোনো কঠিন বস্তু গ্রন্থিবদ্ধ। তখন সেটি সে মোচন করে নেয়। শেষে উঠে এসে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করে পূর্ণ করে দেয় সমাধিগৰ্ভটি।
প্রক্রিয়াটি যেমন দীর্ঘ তেমনই কষ্টকর। সমাধি পার্শ্বের ভূমিতে সে কিছুক্ষণ লম্বমান হয়, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে সে। তারপর বিদায়।
কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে জানে না। বোধ হয় তখন মধ্যরাত্রি। শীত বোধ হওয়াতে সে উঠলো। এবং তখনই দৃষ্টি পতিত হলো বৃদ্ধের স্কুল কটিবন্ধটির উপর। সেটির গ্রন্থিমোচন করার পর যা দেখলো তাতে তার চক্ষুস্থির।
একেবারেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। স্বর্ণমুদ্রাগুলি সে চেনে কিন্তু ক্ষুদ্র প্রস্তরবৎ বস্তুগুলি কী? একটি হাতে তুললে দেখলো তার মধ্য থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এগুলি হীরক? নাকি পদ্মরাগ? নাকি বৈদূর্য? সংখ্যায় সাতটি, কিন্তু কোনোটির পরিচয়ই সে জানে না। তার চিন্তা হলো, এখন সে কী করবে? এই স্বর্ণখণ্ড ও মণিমাণিক্যগুলি কি নিজে নেবে, না সমাধির কাছেই রেখে যাবে?
বিচিত্র এক মানসিক অবস্থা তখন তার। স্বাভাবিক চিন্তা করার অবস্থাটুকুও নেই। না হলে অমন মূল্যবান বস্তু সে সমাধি পার্শ্বে রেখে আসার চিন্তা করে? কি অদ্ভুত কাণ্ড, হঠাৎ সে বিপুল সম্পদের অধিকারী। হীরক মাণিক্যের মূল্য সে জানে না, কিন্তু দশখানি স্বর্ণখণ্ড? এক কূলব্যাপ ভূমির মূল্য তিন দীনার। তার অর্থ চারি কূলব্যাপ ভূমি সে ক্রয় করতে পারবে। কি ভয়াবহ কাণ্ড। হায়, হায়, মানুষ জানলে একেবারে নিশ্চিত মরণ। পিতা হেমন্তদাস জানলে তাকে গৃহ থেকে বিতাড়ন করবেন। যদি তা নাও করেন, ধনরত্নগুলি নিশ্চয়ই আত্রেয়ী জলে নিক্ষেপ করবেন। দস্যু হস্তে প্রাণ কে দিতে চায়?
একবার মনে হলো, সন্ধান করলে যবন বণিকের স্বদেশবাসী কাউকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে–আর তার হাতে স্থলীটি তুলে দিতে পারলেই সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার ভিন্ন চিন্তা হয় আবার। যার হাতে সে স্থলীটি দেবে সে যদি যথাস্থানে সেটি না দেয়, তাহলে?
অর্থাৎ এই দশখানি স্বর্ণখণ্ড এবং মণিমাণিক্যগুলি তাকে নিতেই হচ্ছে–অন্য কোনো গত্যন্তর নেই।
০৩. বসন্তদাসের বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী
বসন্তদাসের বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী ঐ স্থানে অর্থাৎ দেবীকোটের পরিত্যক্ত ঐ মেলাতেই সমাপ্ত হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। তার গৃহের পথ তখনও বহুদূর। আরও বহুবিধ ঘটনা ঘটেছে পরবর্তী পর্যায়ে, যে ঘটনাগুলি বর্তমানের বসন্তদাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেগুলি আমরা পরে জানবো একে একে।
পুনর্ভবার পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সে অনুসন্ধান করতে করতে উত্তরে অগ্রসর হচ্ছিলো। তার অনুমান, পূর্বে বা দক্ষিণে প্রাণ ভয়ে ভীত পলায়নকারীরা যাবে না। শুকদেব যদি জীবিত থাকেন, তাহলে তিনি পশ্চিমে অথবা উত্তরেই এসেছেন। ইতোমধ্যে সে সংবাদ নিয়েছে যে মাতুল দীনদাসও গৃহে ফেরেননি। তাঁর এক ভাগিনেয় পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সন্ধান করতে এসেছিলো।
মদনপুরের দিকে সে অগ্রসর হচ্ছিলো। জানা ছিলো, শুকদেবের এক বন্ধু থাকেন ঐ গ্রামে–যাঁর কন্যার সঙ্গে মৃত চন্দ্ৰদাসের বিবাহের কথা স্থির হয়েছিলো। শুকদেব সম্ভবত বন্ধুগৃহেই আশ্রয় নিয়েছেন, এই প্রকার অনুমান করেছিলো সে। কিন্তু দেখলো, মদনপুরে শুকদেব আসেননি। বৃদ্ধ প্রফুল্ল দাস জানালেন, বৎস, আমিও তাদের সন্ধান করছি, কিন্তু এখনও সফল হইনি, মঙ্গলময় শিব জানেন, তাঁরা কোথায় আছেন। আমার সন্দেহ, তাঁরা কেউ পশ্চিম তীরে আসেননি। যদি জীবিত থাকেন, তাহলে পূর্বতীরেই কোনো গ্রামে তাঁরা রয়েছেন–তুমি বরং পূর্বতীরেই তাদের সন্ধান করো।