পরদিন প্রত্যুষে সে যাত্রার আয়োজন দেখতে গিয়েছিলো। সেখানেই গৃহগামী বণিকদের সঙ্গে আলাপে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। পান্থশালায় যখন প্রত্যাগমন করছে তখন সূর্যোদয়ের পর দণ্ডাধিককাল অতিক্রান্তপ্রায়। ঐ সময় লক্ষ্য করে মেলার লোকেরা পলায়ন করছে। কি ব্যাপার! সে একজনকে ডাকলো। জানতে চাইলো, কিছু হয়েছে কি?
সর্বনাশ হয়েছে মহাশয়, প্রাণরক্ষা করতে চান তো পলায়ন করুন। বিসূচিকা, বিসূচিকা দেখা দিয়েছে।
বসন্তদাস ক্ষণেক দাঁড়ায়। সে জানে বিসূচিকা মারী রোগ। এবং মেলায় যদি ঐ রোগ দেখা দেয়, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। সে পলায়নকারীদের ত্রস্ত ভঙ্গি ও মুখভাবে ভয়ানক আতঙ্ক দেখতে পায়। মনে মনে চিন্তা করে, তারও বিলম্ব করা উচিত। নয়।
কিছুদূর অগ্রসর হলে দেখে অক্রূরদাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। নিকটে এসে বলে, সখা বসন্ত, চললাম, যদি জীবিত থাকি দেখা হবে।
বসন্তদাস কঠিন মুষ্টিতে অক্রূরদাসের হাত ধরে। বলে, কি হয়েছে তোমার, উন্মাদের মতো আচরণ করছো কেন?
সখা, আমার, আমারও যেন বমন ভাব হচ্ছে, শেষে আমিও কি আক্রান্ত হলাম? হে ভগবান রক্ষা করো–আমি ছিলাম তার পার্শ্বের শয্যাটিতে। হায়, হায়, কেন যে পান্থশালায় স্লেচ্ছ যবনদের স্থান দেওয়া হয়।
ঐ কথা শোনার পর বসন্তদাস আর মুহূর্তেকও দাঁড়ায় না। তার অনুমান হয়, অন্য কেউ নয়, যবন বৃদ্ধটিই আক্রান্ত হয়েছেন। গত রাত্রে তিনি অসুস্থতার কথা বলেছিলেন।
পান্থশালায় এসে দেখে একটি লোকও নেই। প্রকোষ্ঠে বৃদ্ধ একাকী শয্যাশায়ী। একবার উঠতে চাইলেন, পারলেন না। চক্ষু দুটি কোটরাগত। সুন্দর গৌর মুখখানিতে পাণ্ডুর ছায়া। একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। লক্ষ্য করে দেখলো, বৃদ্ধের নিম্নাঙ্গের শয্যা সিক্ত। শয্যার দুপাশের ভূমিতে বমন চিহ্ন। বোঝা যায়, তাঁর দেহ এখন উত্থানশক্তিরহিত। সে কী করবে বোধগম্য হচ্ছিলো না। একবার ভাবলো, পলায়ন করে। কিন্তু ঐ সময়ই বৃদ্ধ হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন। বসন্তদাসের আর পশ্চাদপসরণ করা হলো না। নিকটে গেলে বৃদ্ধ বললেন, জল দিতে পারো? সে কলস থেকে জল এনে বৃদ্ধের মুখে ধরলো। জলপান করে বৃদ্ধ চক্ষু দুটি মুদিত করে বললেন–তুমি চলে যাও, আমার মৃত্যুর আর বিলম্ব নেই।
মাত্র ঐ কটি কথা উচ্চারণ করেন বৃদ্ধ। কিন্তু বসন্তদাসের মনে হয়, ঐ কথা কটি উচ্চারণ করে যেন জগৎ সংসারকে তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কথা কটির মধ্যে দারুণ তাচ্ছিল্যের ভাব। যেন বলতে চাইলেন, তোমরা আমাকে ত্যাগ করলে, আমিও তোমাদের ত্যাগ করলাম। সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস তুমি কি পলায়ন করবে? তৎক্ষণাৎ মনে হয়, পলায়ন করাই তার উচিত। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার মনে হয়, বৃদ্ধের শয্যাটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পুনরপি লক্ষ্য করে, তার পানের জন্য জলও আবশ্যক হবে। পলায়ন তো সে করতেই পারে। পদযুগল সচল করলেই হয়। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী লোকটির মুখে জল কে দেবে? ঐ নষ্ট শয্যাতেই বা তিনি কেমন করে থাকেন। সে বৃদ্ধকে তুলে পার্শ্ববর্তী শয্যায় নিয়ে গেলো। এবং পুনর্বার জিজ্ঞাসা করলো, জল পান করবেন? জল দেবো?
বৃদ্ধের সম্ভবত আর জ্ঞান ছিলো না। আল্লাহ আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করলেন কয়েকবার, নিজ ভাষায় কিছু যেন বললেন কাউকে। কিছুই বোধগম্য হয় না বসন্তদাসের। সে তখন পান্থশালার বাইরে আসে। মেলার লোক তখনও পলায়ন করছে। পলায়নপর একজনকে ডাকলে লোকটি কর্ণপাত করে না। সে ছুটে লোকটিকে ধরলো। জানতে চাইলো, একজন বৈদ্যের সন্ধান দিতে পারেন? লোকটি আর্তনাদ করতে লাগলো, ভ্রাতঃ আমাকে যেতে দিন–গৃহে আমার স্ত্রী-পুত্র আছে।
মুক্ত হয়ে লোকটি এমন গতিতে ধাবমান হলো যে মুহূর্তেক পরে আর তাকে দেখা গেলো না।
বসন্তদাসকে অবিলম্বে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে একজন বৈদ্য ডেকে আনতে হয়। বৈদ্য এসে দূর থেকে রোগীর অবস্থা দেখে আর অগ্রসর হন না। বলেন, ম্লেচ্ছ যবনদের চিকিৎসা আমি করি না।
বসন্তদাস তখন একপ্রকার মরিয়া। বৃদ্ধের স্কন্ধে হাত রেখে বলে, মহাশয়, আমি আপনার শমন, ঐ ম্লেচ্ছ যবনের সঙ্গে যদি একত্রে যমালয়ে গমনের বাসনা না থাকে, তাহলে রোগীর চিকিৎসা করুন।
বৈদ্যটি অম্বোষ্ট কায়স্থ, সম্ভবত তাঁর কৌলীন্যেরও দাবি আছে–অন্তত উপবীতটি দেখে তাই মনে হয়। উপবীত স্পর্শ করে তিনি বসন্তদাসকে যথেচ্ছ অভিসম্পাত দিলেন। তারপর রোগীকে পরীক্ষা করলেন। শেষে বললেন, এ রোগীর আশা নেই–পারলে প্রস্তর লবণের চূর্ণ মিশ্রিত করে জলপান করাও। অন্য কিছু করণীয় নেই।
বৈদ্যটি প্রস্থান করার সময় হস্ত প্রসারণ করতে ভুললেন না। একটি মুদ্রা হাতে পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বিদায় হলেন।
বৃদ্ধ পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। প্রস্তর–লবণ তখন আর কোথায় সন্ধান করবে? পান্থশালার রন্ধনস্থলে কৃষ্ণ–লবণ ছিলো, তাই জলে মিশ্রিত করে বার দুই দেওয়া সম্ভব হলো। তারপরই বৃদ্ধের শেষ নিঃশ্বাসটি নির্গত হয়ে চলে গেলো।
শিয়রে তখন সে উপবিষ্ট। মৃত্যুকে এতো নিকট থেকে পূর্বে সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। তার অদ্ভুত লাগছিলো। এই লোকটির সঙ্গে গত রাত্রেই না তার আলাপ হয়েছে। এরই দেওয়া পুষ্পসবের সুগন্ধ পাত্রটি এখনও না তার সঙ্গে। অথচ লোকটি জগৎ থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। দূরদেশে স্ত্রী–সন্তান পরিবার অপেক্ষায় রয়েছে আর ইনি নির্বান্ধব অবস্থায়, প্রবাসে এক পান্থশালায়, শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করে বসলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ কেউ জানতেও পারলো না। সে বৃদ্ধের চক্ষু দুটি মুদিত করে দিলো। একখানি হাত শয্যার বাইরে ভূমিস্পর্শ করেছিলো। হাতখানি সে বক্ষোপরি স্থাপন করলো। তারপর বললো, মহাশয় বিদায়, এবার আমি যাই, পরকালে আপনার মঙ্গল হোক।