বসন্তদাস দুতিনটি দিন মাত্র বৃদ্ধের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে। কিন্তু ঐ দুতিন দিনেই বৃদ্ধ তার কাছে বহু কথা বলেছেন। পশ্চিম দেশে নাকি এক শ্রেণীর শস্ত্রধারী যবনের। আবির্ভাব হয়েছে যাদের নাম তুরুক। ঐ যবনেরা একের পর এক রাজ্য জয় করছে। তারা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই নাকি বর্বর। ধ্বংস ও লুণ্ঠন ব্যতীত তারা অন্য কিছু বোঝে না। আবার এও এক অদ্ভুত কথা যে যবন বণিকদের ধর্ম ও তুরুকদের ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব নেই–বরং শত্রুতা ভাবই পোষণ করে গোপনে গোপনে এইরূপ নানান কথা বৃদ্ধের। তবে এই সকল কথার মধ্য দিয়ে বসন্তদাস একটি ভিন্নতর জগতের সন্ধান পাচ্ছিলো। যেমন, সমস্ত কিছুই ললাটলিপি নয়–রাজা রাজপুরুষ কেউ অজেয় নয়। রাজার বিরুদ্ধে প্রজা দ্রোহ উত্থাপন করতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সফলও হয়। আরও বুঝছিলো, ছুম্মার্গ একেবারেই অহেতুক। স্পর্শ মাত্রই খাদ্যবস্তু নষ্ট হয় না। যে মনে করে হয়, সে মূর্খ। চণ্ডাল ব্রাহ্মণভেদে জলের গুণাগুণের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না–জল জলই থাকে। কেবল দেবতা সম্পর্কিত বিষয়টি সে বোঝেনি। প্রকৃত কথা এই যে, মেলায় অবস্থান এবং যবন বণিকের সান্নিধ্য বসন্তদাসের মনের মধ্যে একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে দেয়। বস্তুর আপাত অবয়বের পশ্চাতেও যে অন্যকিছু থাকতে পারে, সে বিষয়ে সে এখন সজাগ ও সচেতন।
শঙ্খদত্তের আশা সে ত্যাগ করেছিলো। সুতরাং মেলায় অবস্থানের কোনো যুক্তিই তার ছিলো না। কেবলি মনে হচ্ছিলো, অহেতুক তার কালক্ষেপণ। অতঃপর সে গৃহে প্রত্যাগমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধান করে সে পূর্বগামী একদল বণিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। হ্যাঁ, তারা জানায়, শকটারোহণে বসন্তদাস স্বচ্ছন্দে তাদের সঙ্গে যেতে পারে।
সুতরাং বিলম্ব কেন, শিবনাম স্মরণ করে এবার যাত্রা করো, অক্রূরদাস পরামর্শ দেয়।
মেলায় সে তিনটি ক্ষুদ্র দ্রব্য ক্রয় করে। বলাবাহুল্য, সবই মায়াবতীর জন্য। একটি স্বর্ণাঙ্গুরীয়, যার পৃষ্ঠে তিনখানি ক্ষুদ্র বর্ণাঢ্য প্রস্তুরখণ্ড, দুটি রক্তবর্ণ চুনির মধ্যস্থলে একটি শুভ্র মুক্তাফল। দেখলে নয়ন জুড়ায়। তার দ্বিতীয় ক্রয়ের বস্তু একটি ক্ষুদ্র তৈলপাত্র। কাংস্যনির্মিত, কিন্তু এমনই উজ্জ্বল যে চক্ষু ধাধে–ভ্রম হয়, বুঝিবা স্বর্ণ। তবে পাত্রটির আকর্ষণ উজ্জ্বলতার কারণে নয়। তার আকর্ষণ বহিরঙ্গের খোদিত ফুল লতাপাতার কারণে। আর তৃতীয় বস্তুটি হলো গজদন্ত নির্মিত ক্ষুদ্র একটি সিন্দুর পাত্র। পাত্রটি এমনই হৃদয়গ্রাহী যে একবার দৃষ্টিপাত করলেই মনে হবে, আহা এমন আর হয় না।
সন্ধ্যাকালে মেলায় যখন ঐ দ্রব্যগুলি ক্রয়ে সে ব্যস্ত, ঐ সময় যবন বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি তরল পদার্থে পূর্ণ ক্ষুদ্র একটি পাত্র এনে দিলেন হাতে। পাত্রটির মুখ বন্ধ ছিলো। এবং আকারে সেটি অঙ্গুলি পরিমাণ হবে কি না সন্দেহ। পাত্রটি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের বাতাস সুগন্ধে এমন আমোদিত হয়ে উঠলো যে বলার কথা নয়। তরল পদার্থটি নাকি পুষ্পসব। তথ্যটি জানিয়ে বৃদ্ধ বললেন, বধূমাতাকে দিও এটি, শয়নকালে যেন বিন্দু পরিমাণ অঙ্গে লেপন করেন।
পদার্থটির নাম নাকি ইতর। হাস্যকর নাম বলতে হবে। বসন্তদাসের কৌতুক বোধ হয় নাম শুনে। বলে, এক দেশের বুলি তাহলে সত্যসত্যই অন্য দেশের গালি হয়ে থাকে।
বৃদ্ধের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা পূর্বেই হয়েছে। তথাপি ঐ স্নেহের দান গ্রহণ করে সে অভিভূত বোধ করে। বলে, মহাশয়, আমি আপনাকে বিনিময়ে কী দেবো বুঝতে পারছি না। বৃদ্ধ হাসেন। অতঃপর জানান, তোমার কিছু দেওয়ার প্রয়োজন নেই–তুমি এই বৃদ্ধকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতেই আমি অভিভূত–এদেশে এমন আত্মীয়জ্ঞান আমাকে কেউ করেনি।
বৃদ্ধ বিদায় নিলেন। বললেন, আমি কিঞ্চিৎ অসুস্থ বোধ করছি। প্রভাতে যদি নিদ্রিত থাকি, কিছু মনে করো না।
ইতস্তত ভ্রমণকালে অক্রূরদাসের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ।
সে কৌতুক স্বরে বললো, সখা বসন্ত, যাবে নাকি একবার, শেষবারের মতো?
বারাঙ্গনা পল্লীতে যাবার ইঙ্গিত। বসন্তদাস হাসে। বলে, না সখা, আমার সঞ্চয়ে অতো রস নেই যে যত্র তত্র ঢালবো, তুমি যাও।
সে আরও দ্রব্য ক্রয় করতে পারতো, কিন্তু করলো না। নিজের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে যা আছে। তা সে অন্যভাবে ব্যয় করতে চায়। অর্থোপার্জন যে কি বস্তু, সে তো তার দেখা হয়েছে। না, আর বাণিজ্য নয়। বন্ধু শঙ্খদাস তাকে যথোপযুক্ত শিক্ষাটি দিয়ে গেছে। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, তার ক্ষেত্রকর হওয়াই উচিত। গৃহে যদি স্বর্ণমুদ্রা কটি অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, তাহলেই সে নিজেকে সৌভাগ্যবান বিবেচনা করবে। যা তার সঞ্চয়ে আছে, একজন ক্ষেত্রকরের কাছে তার মূল্য বিপুল। এই অর্থে সে দুই কূলব্যাপ পরিমাণ ভূমি ক্রয় অনায়াসে করতে পারে। ঐ পরিমাণ ভূমি ক্রয় কম কথা নয়। দুই না হোক, এক কূলব্যাপ ভূমি অবশ্যই ক্রয় করবে সে। সামন্তপতিরা কেউ না কেউ স্বর্ণের বিনিময়ে নিশ্চয়ই ভূমিদান করতে সম্মত হবে। অন্য কেউ না হোক, কুশলদত্ত তো নিশ্চয়ই হবে। কেননা তার অর্থাভাব সর্বক্ষণ থাকে। সুতরাং এখন থেকে বসন্তদাস ক্ষেত্রকরের পুত্র ক্ষেত্রকর। সে চিন্তা করে দেখেছে, এই ব্যবস্থাই উত্তম। দেশে দেশে ভ্রমণ–কিন্তু পরিণামে লাভ বন্ধুর প্রতারণা, দস্যুর আক্রমণ এবং রাজপুরুষদের তাড়না। কি প্রয়োজন ঐ বৃত্তির। ক্ষেত্ৰকৰ্মই তার জন্য উত্তম।