০১. উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত
০১.
উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয় তখন বসন্তদাস পুনর্ভবার পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতে ভিক্ষু মিত্রানন্দের সন্ধান করে ফিরছে। মিত্রানন্দকে তার বিশেষ প্রয়োজন। তাকে যে উজুবট গ্রামের উত্তরপাটক পল্লী থেকে পলায়ন করে আসতে হয়েছে শুধু সেই কারণেই নয়। তার আশঙ্কা হচ্ছিলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির শীঘ্রই পুনরাবৃত্তি হবে। সামন্ত হরিসেন তো আর একাকী ঘটনাটি ঘটাননি। তাঁর সঙ্গে বহু অনুচর ছিলো। ঐদিন যারা ঘটনাটি ঘটাতে সহায়তাদান করেছিলো তারা নিজেরাও যদি ঐ প্রকার ঘটনা ঘটাতে চায়, তাহলে কে বাধা দেবে? ব্যাঘ একবার শোণিতের স্বাদ পেলে তা কি আর ত্যাগ করে? একইসঙ্গে আবার সে শুনতে পাচ্ছিলো, যবন সেনাদল নাকি পশ্চিমে অবস্থান করছে। অশ্বারোহণে দশ/পঞ্চদশ ক্রোশ আর এমন কি দূরত্ব? তদুপরি জানে, লাঞ্ছিত অপমানিত ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ এই পথেই গমন করেছেন। এখন যদি তরুণ ভিক্ষুদের আগ্রহাতিশয্যে শুদ্ধানন্দ যবন সেনাদলকে আহ্বান করেন, তাহলে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হবে। নিকটবর্তী গ্রাম জনপদগুলি একেবারে শ্মশান হয়ে যাবে। তার ধারণা, এই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিত্রাণের পথ কেউ যদি উদ্ভাবন করতে পারে তো সে হলো মিত্রানন্দ এবং তার সহচরেরা।
কিন্তু কোথায় মিত্ৰানন্দ? যে স্থানেই সে উপনীত হয়, সে স্থানেই শোনে, আহা দিনেক পূর্বে এলেন না–মাত্র গতকালই তিনি এ গ্রাম ত্যাগ করেছেন।
সে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে যাচ্ছিলো। ঐ সময় মালঞ্চ হাটে এক গন্ধবণিক তাকে সংবাদটি দেয়। বিশদ কিছুই বলতে পারেনি সে। শুধু জানায় যে, উজুবট গ্রামখানি একেবারেই ভস্মসাৎ হয়েছে–একটি প্রাণীও নাকি রক্ষা পায়নি।
সংবাদটি আকস্মিক এবং ভয়াবহ। বসন্তদাস কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরক্ষণেই সে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে। বলা বাহুল্য, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থা হয় তার। তখন অপরাহ্নকাল, পথ নির্বিঘ্ন নয় এবং যেতেও হবে তিন ক্রোশাধিক পথ। কিন্তু সেসব বিষয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিলো না।
দ্রুত পথক্ৰমণ করছিলো সে, আর ঐ সময় ক্ষণে ক্ষণে মায়াবতীর মুখখানি সে মনের ভেতরে দেখতে পাচ্ছিলো। বড় মায়া মুখখানিতে। তার বাহু দুখানির উষ্ণ স্পর্শ সে গণ্ডদেশে এখনও অনুভব করে। কি স্নিগ্ধ, কি পবিত্র এবং কি গম্ভীর হতে পারে প্রিয়তমা নারী, তা সে মায়াবতাঁকে না পেলে কখনই জানতে পারতো না। মায়াবতীর সান্নিধ্যই তাকে সেই উপলব্ধি দান করেছে যার কারণে মুক্তস্বভাব পুরুষ সংসার–জীবনে স্থির থাকতে পারে। সন্তানের কথাও তার কল্পনায় উদিত হচ্ছিলো। আহা, শিশু কোলে না থাকলে রমণী কি আর রমণী? তার এখন মনে হয়, সে সংসার–জীবনের সারাৎসারে প্রায় উপনীত হতে যাচ্ছিলো। ক্রমেই তার উপলব্ধি হচ্ছিলো, জীবন এইভাবেই ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়, পূর্ণতা লাভ করে এবং ক্রমে একটি পরমার্থতায় উপনীত হয়। তার বিশ্বাস, জীবনের পরমার্থতা অন্য কিছুতে প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় সৃজনে। আর এও তার মনে হয় যে, সংসারই সৃজনের আধার, সংসার ধ্বংস হয়ে গেলে সৃজন প্রক্রিয়া আর থাকে না। ধর্ম বলো, সংঘ বলো, রাষ্ট্র বলো, সকলই সংসারকে রক্ষা করার কারণে। সংসারের কারণেই মানুষের যাবতীয় বৃত্তি এবং কর্মকাণ্ড। সুতরাং সংসারকেই জগতের সকল অস্তিত্বের কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে। এই প্রকার একটি সরল মীমাংসায় উপনীত হচ্ছিলো সে। এবং ঐ সংসার সম্পর্কেই প্রেমধর্মের কথাটি এসে যাচ্ছিলো। প্রেম না হলে কি সংসার হয়? আর সংসার না হলে তো জীবন হয় না। এবং জীবন যদি না থাকে, তাহলে জগতের অস্তিত্ব কোথায়? মীমাংসাটি এইভাবে বিন্যস্ত করে সে মিত্রানন্দের কাছে জানিয়েছিলো। এবং ঐ সূত্রেই মানুষে মানুষে প্রীতি ও সদ্ভাবের কথাটি তুলেছিলো। সনাতন ও সদ্ধর্মীদের মিলন যে ঐ সূত্রেই হতে পারে তাও সে জানিয়েছিলো। মিত্রানন্দ জগদ্দল মহাবিহারে একখানি পত্র নিয়ে যাচ্ছে তখন। ঐ সময়ই সে অনুরোধটি করে। মহাভিক্ষু ও মহাশ্রমণদের মধ্যে ঐ সরল মীমাংসার কথাটিও যেন আলোচিত হয়।
কিন্তু এ কোন দুষ্কালের আবির্ভাব ঘটলো! জীবনের ধ্বংস প্রক্রিয়া কি এতোই দ্রুত অগ্রসর হয়? সময় এত বৈরী কেন? মানুষ কি সামান্য কিছুকালও ধৈর্য ধারণ করতে পারে না? বলাধিকার থাকলেই তা প্রয়োগ করতে হবে? তার কিছুতেই বোধগম্য হয় না একজন বয়স্ক, বুদ্ধিমান, সম্ভ্রান্ত ও সামাজিক মানুষ কীভাবে অন্যের ধনসম্পদ, সংসার, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত হরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারে। এ কি শুধুই লোভ? শুধুই জিঘাংসা? তোমার পুত্র তোমার নয়, সে আমার দাস হবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী তোমার নয়–সে আমার শয্যাসঙ্গিনী হবে। তোমার ধনসম্পদ কেন থাকবে তোমার অধিকারে? তা থাকবে আমার অধিকারে।
তার একেক সময় জানার বাসনা হয়, এ কি তাহলে মানুষের চূড়ান্ত পতন? এখন পাশবিকতার জয়জয়কারই হবে সত্য? মহাকাল তার শেষ ঘোষণাটি দিয়ে বসে আছেন– কেবল মৃত্যু ও মিথ্যাই সত্য–অন্য কিছু নয়।