সোনা-টিয়া বলল, কেন, হোটেলওলা, দেখতে পাব না কেন?
–সে অনেক কথা, বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না। এখানে সবাই জানে আমি বটতলার হোটেলওলা, পয়সার কুমির। কিন্তু আসলে আমি যে কে, কেন টাকা জমাই তা কেউ জানে না। আমি গোঁফ দিয়ে মুখ ঢেকে লুকিয়ে থাকি সাধে? আমাকে চিনলে ওরা আমায় আস্ত রাখবে না! দাড়িটাকে কত ভয়ে ভয়ে শুকুতে দিতে হয়, তাও কেউ জানে না! ভাগ্যিস এই সময় ঘাসজমিতে জানোয়ারদের খেলা দেখতে সবাই যায়, নইলে আমাকে দেখতে পেতে না। এমনিতেই একটু পায়ের শব্দ শুনতে পেলেই আঁতকে উঠি!
ঘাসজমিতে জানোয়ারদের খেলার কথা শুনে সোনা-টিয়া কি আর সেখানে থাকে? শেষপর্যন্ত হোটেলওলাই ভিজে দাড়িগোঁফটি পকেটে পুরে ওদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিল। এমন সময় দেখা গেল ভারী একটা হাঁড়িপানা মুখ করে মাকু আসছে। তারই কাছে সোনা-টিয়াকে ভিড়িয়ে দিয়ে হোটেলওলা রান্না শেষ, করতে ফিরে গেল।
–কই, আমাদের দুটো খরগোশ কই, মাকু?
-বাঁশঝাড়ে খরগোশ-টরগোশ দেখলাম না।
–তোমার চাবি ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি মাকু? হাঁড়িমুখ করেছ কেন?
মাকু তো অবাক, সে কী, চাবি আবার ফুরুবে কী?
সোনা-টিয়ার কানে কানে বলল, দূর বোকা, চাবির কথা ও জানবে কী করে? ও ভাবেও সত্যি মানুষ!
মাকু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ছিঃ! কানে কানে কথা বলতে হয় না! অন্য লোকেরা তাহলে মনে দুঃখ পায়।
দুজনায় মাকুকে জড়িয়ে ধরে বলল, না মাকু না, তোমাকে আমরা খুব ভালোবাসি। ঘাসজমি কত দূরে?
-এই যে এসে পড়লাম, শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?
সত্যিই কানে এল ঝমঝম ট্যাম-ট্যাম ভ্যাঁ-পু-পু-পু ভো। আনন্দের চোটে ওদেরও পাগুলো নেচে উঠল। তারপর গাছপালা পাতলা হয়ে এল, মস্ত ফঁকা সবুজ ঘাসজমি দেখা গেল।
তাই বলে সত্যি সবটা ফাঁকা নয় মোটেই। খানিকটা খোলা জায়গা ঘিরে গোল হয়ে ভিড় করে রয়েছে একদল মানুষ। এদেরই অনেককে কাল রাতে সোনা-টিয়া বটতলার হোটেলে খেতে দেখেছিল। সোনা-টিয়াদের দেখে সবাই হই হই করে উঠল, আজ রাতে-না মালিকের জন্মদিনের ভোজ? হোটেলের চাকররা তাহলে কেন সকাল বেলায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে? কাজকর্ম নেই নাকি?
সোনা বলল, গায়ে ফুঁ দিইনি মোটেই।
টিয়া বলল, আমরা ছোটো, আমরা কি কাজ করতে পারি?
মাকু বলল, তা ছাড়া আমরা তো জানোয়ারদের খেলা দেখতে এসেছি।
যেই-না বলা অমনি ঢ্যামকুড়কুড় করে বাজনা বেজে উঠল আর ঘাসজমির এক পাশের চাটাইয়ের ঘরের দরজা খুলে দশটা কোঁকড়া চুল কুকুর পেছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দু-পা দিয়ে লাল ফিতে বাঁধা করতাল বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এল। ট্যামকুড়-কুড় ট্যামকুড়-কুড় ট্যামকুড় কুড় ভ্যাঁপুভ্যাঁপুভ্যাঁপু– ভেঁপর ভেঁপর ভো! ব্যস, কুকুরেরা এক লাফ দিয়ে উঠে এক পায়ে পাঁই পাঁই করে ঘুরতে লাগল। আর অমনি টগর বগর টগর বগর করে চারটে বাঁদর টুপি মাথায় দিয়ে চারটে ঘোড়া হাঁকিয়ে উপস্থিত! সং এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে কতরকম খেলা দেখাল তার ঠিক নেই।
দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে লাগল, খেলা যখন শেষ হল সূর্যটা প্রায় মাথার ওপর। আর দেরি করা নয়, ভিড় ঠেলে তিন জনে বটতলার দিকে পাঁই পাঁই ছুট। একা একা রাজ্যের কাজ নিয়ে হোটেলওলা না-জানি কত কষ্টই পাচ্ছে। মাঝপথে আবার এক কাণ্ড। ওরা দেখে একটা খাকি কোট-পেন্টেলুন পরা লোক, থলে কাঁধে, কোমরে লণ্ঠন বাঁধা, হাতে একটা লম্বা খাম নিয়ে ঝোপেঝাড়ে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখেই তো সোনা-টিয়ার হয়ে গেছে, এবার আর মাকুর রক্ষা নেই, ওকে ধরে নিয়ে যেতেই যে লোকটা এসেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আবার দারোগার কাছ থেকে চিঠি এনেছে ভালো করে খুঁজবে বলে লণ্ঠন এনেছে, থলিতে ভরে নিশ্চয় বেঁধে নিয়ে যাবে! ঘড়িওলাই হয়তো ওকে জেলে পুরতে চায়!
আর কি সেখানে থাকা যায়? মাকুর দু-হাত ধরে টানতে টানতে সোনা-টিয়া মস্ত একটা ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে লুকোল। ইদিক-উদিক তাকাতে তাকাতে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লে পর, ওরা বেরিয়ে এক দৌড়ে একেবারে বটতলা। হোটেলওলা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। তার মাথা থেকে পা অবধি কালো কাপড়ে ঢাকা, দূর থেকে ওদের পায়ের শব্দ শুনেই লোকটি সুড়ুৎ করে বনের মধ্যে গা ঢাকা দিল।
–কে ওই লোকটা? ও হোটেলওলা, ও কেন এসেছে?
হোটেলওলা বলল, কে আবার লোক? লোক কোথায় দেখলে আবার? সেই তখন থেকে একলা একলা খেটে মরছি, গয়লা এক মন দুধ দিয়ে গেছে, সং পাঁচ সের বাতাসা কিনে এনেছে, রাতে ভুনিখিচুড়ি হবে, তার জন্য সুগন্ধি চাল, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ এনেছে, শিকারিরা হরিণের মাংস দিয়ে যাবে বলে গেছে, তাল তাল মশলা পড়ে আছে, কিন্তু কাজ করার মানুষরা সব তামাশা দেখতে গেছে।
এই বলে হোটেলওলা গাল ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে পাথরটার ওপর বসে পড়ল। মাকু আর কোনো কথা না বলে উনুনে দুটো চ্যালা কাঠ গুঁজে দিয়ে বিরাট দুধের কড়াইটা চাপিয়ে দিল। ওর গায়ের জোর দেখে সোনা-টিয়া অবাক। হোটেলওলা, ও মানুষ, তোমার গায়ে তো দেখছি পাঁচটা মোষের শক্তি, তা কাজে এত গাফিলতি কেন?
টিয়া বলল, ও যে কলের মা–। সোনা ওর মুখ টিপে ধরে বলল, চুপ, বোকা! মাকু আর হোটেলওলা অবাক হয়ে দু-জনার দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ টিয়া ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। মাকুর চাবি ফুরিয়ে গেলে মাকু মরে যাবে। আমাদের ভাত খাবার সময় হয়ে গেছে, আঁ আঁ আঁ!