সোনা বলল, সার্কাসের লোক তো বনের মধ্যে কেন? হোটেলওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, বলেনি বুঝি সং? নতুন তাবু কিনে, বড়ো ঝাড়বাতি কিনে, সকলের নতুন পোশর বানিয়ে চারদিকে নতুন খেলার বিজ্ঞাপন দিয়ে, খেলা শুরু হবার আগেই কোনো জিনিসের দাম না দিয়ে, কাউকে কিছু না বলে, ওদের অধিকারীমশাই যে পালিয়েছে! দোকানদাররা থানায় খবর দিয়েছে, জিনিসপত্র সব টেনে নিয়ে আটক করেছে, অধিকারীমশাই নিখোঁজ, তাই এদের নামেই পরোয়ানা বের করেছে, দেখা পেলেই ধরে নিয়ে ফাটকে দেবে। তাই এই জঙ্গলের মধ্যে ওরা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আমি খাওয়াই-দাওয়াই যেটুকু পারি মওড়া দেওয়াই, দুঃখী লোকদের সাহায্য করতে হয়।
আরও কী বলতে যাচ্ছিল হোটেলওলা! কিন্তু তখুনি পোঁও-ও করে জাদুকরের সাকরেদ বাঁশিতে টান দিল। আর সঙ্গেসঙ্গে মাটির ওপর জড়োকরা মোটা দড়িগাছা কিলবিল করে জ্যান্ত হয়ে উঠল।
জাদুকর তখন শূন্যে হাত ছুঁড়ে সুর করে বলল, তোমরা সবাই চুপ!
লাগ ভেল্কি লাগ
আকাশ পানে তাগ!
তাড় হাঁকড়া
পাখি পাকড়া
লাইম্মা পড়িস ঝুপ।
সঙ্গেসঙ্গে সাঁ করে দড়ির একটা মাথায় ঢিলে ফঁসের মতো লেগে সবসুদ্ধ মগডাল অবধি উঠেই আবার সোঁ করে নেমে এল। সোনা-টিয়া অবাক হয়ে দেখল, কোত্থেকে কখন একটা কালো টাট্ট ঘোড়া এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখেনি, তারই পিঠে ঝুপ করে যখন দড়িগাছা নামল, টাটু ঘোড়ার সোনালি জিনের ওপর দাঁড়িয়ে স্বয়ং পরিদের রানি!
০৪.
সোনা-টিয়া হাঁ করে চেয়ে রইল। পরিদের রানির গোলাপি মুখে কী সুন্দর কালো কালো চোখ, মাথায় সোনালি চুল, পরনে রুপোলি পোশাক, কোমরে জাদুকরের দড়ি জড়ানো। যেই ঘোড়া মাথা নেড়েছে আর ঘণ্টার মালা ঝুমুর ঝুমুর বেজে উঠেছে, অমনি এক ঝাঁকি দিয়ে দড়ির ফঁস ঝেড়ে ফেলে পরিদের রানি দুই ঘোড়ায় পা রেখে নেচে উঠেছে। সে কী নাচ! নাচ দেখে গাছের উপর থেকে টুপটাপ করে রাশি রাশি ফুল ঝরে পড়তে লাগল আর জাদুকর সঙ্গে সঙ্গে লম্বা একটা চোঙার মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। তারপর কখন এক সময় বাঁশি থামিয়ে জাদুকর আবার দড়ির ফাস তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল। দড়ি গিয়ে পরিদের রানিকে জড়িয়ে ধরে, পাক খেতে খেতে তাকে সুদ্ধ আবার গাছের মগডাল অবধি উঠে গেল।
আর কিছু দেখা গেল না, শুধু এক রাশি লাল ফুলের সঙ্গে দড়িগাছা ছপাৎ করে আবার এসে মাটিতে পড়ল।
হোটেলওলা সোনা-টিয়ার কানে কানে বলল, এমন খেলা কেউ কখনো দেখেছে? আমাদের জাদুকর হল গিয়ে জাদুকরদের রাজা। চলো এবার রাঁধাবাড়ার কাজে লাগা যাক। এ-বেলায় মাছের স্টু-ভাত আর রাতের সুরুয়া এখনই তৈরি করে রাখতে হবে যে! মনে নেই আজ রাত্রে আমার জন্মদিনের ভোজে সকলের নেমন্তন্ন। ভুনিখিচুড়ি, হরিণের মাংসের কোর্মা আর পায়েস। সেইসঙ্গে সুরুয়া না দিলে ওরা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। উটি আবার লুকিয়ে করতে হয়, নিয়মটি কাউকে জানাবার মতো নয়।
বটতলার পেছন দিকে রান্না হয়, তারই পাশ দিয়ে সেই ছোটো নদীটি বয়ে চলেছে। তিনটে করে বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে উনুন হয়েছে, তাতে কাঠের জ্বালে বিরাট বিরাট পেতলের হাঁড়া চাপানো হয়। সোনা-টিয়া সুরুয়া খাবার কাঠের বাটিগুলো নদীর জলে ভালো করে ধুয়ে সারি সারি উপুড় করে একটা চ্যাপটা পাথরের উপর সাজিয়ে রাখল। তারপর হোটেলওলার স্টুয়ের জন্য ছোট্ট ছোট্ট বুনো মটরশুটি ছাড়িয়ে দিল।
হোটেলওলা বলল, এগুলো এমনি হয়, কিনতে হয় না। আগে এখানে লোকের বসতি ছিল কি না, তখন তারা মটরের বিচি পুঁতেছিল, এখন ঝাড় বেঁধে আপনি হয়। গাছতলায় মিষ্টি শাঁকালু হয়, পালং শাক হয়, টমেটো হয়; ডুমুর গাছে ডুমুর হয়, শজনে গাছে শজনে হয়। বাকি জিনিস গ্রামের হাট থেকে কিনে আনতে হয়।
সোনা বললে, কে কিনে আনে?
হোটেলওলা বললে, কেন, সং তো হপ্তায় তিন বার গাঁয়ের পোস্টাপিসে যায়, সে-ই কতক আনে। আর কতক আমার ভাই লুকিয়ে দিয়ে যায়।
–কেন সং হপ্তায় তিন বার পোস্টাপিসে যায়?
–ওমা, সে যে লটারির টিকিট কিনেছে, যদি একবার জিতে যায় তো একসঙ্গে অনেক টাকা পেয়ে বড়োলোক হয়ে যাবে। তাই খবর আনতে যায়। খুব সাবধানে যেতে হয়, কারণ ওরা যে। এখানে লুকিয়ে আছে থানার দারোগা একবার জানতে পারলে, সবসুদ্ধ পায়ে বেড়ি দিয়ে টেনে গারদে পুরবে।
এই বলে মাথায় হাত দিয়ে হোটেলওলা চুপ করে বসে রইল।
সোনা বলল, বলো হোটেলওলা, তোমার ভাই কেন লুকিয়ে-চুরিয়ে বনের মধ্যে আসে?
–তার বড়ো ভয়।
-কীসের ভয়?
–সকলের যে ভয় সেই ভয়, অর্থাৎ ধরা পড়ার ভয়। আর বেশি জিজ্ঞাসা কোরো না সোনা টিয়া, ছোটো মেয়েদের খুব বেশি জানতে চাওয়াটা মোটেই ভালো নয়।
এই বলে লাফিয়ে উঠে হোটেলওলা উনুনে-চাপানো সুরুয়ার হাঁড়ির ঢাকনি খুলে এই বড়ো একটা কাঠের হাতা দিয়ে নাড়তে লেগে গেল আর অমনি তার মুখ থেকে দাড়ি গোঁফজোড়া খুলে টপ করে হাঁড়িতে পড়ে সুরুয়ার সঙ্গে টগবগ করে ফুটতে লাগল। সোনা-টিয়া হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, কিন্তু হোটেলওলা এক হাতে ওদের ঠেলে ধরে, অন্য হাতে সুরুয়া ঘুটতে লাগল। তার চাচা ছোলা ন্যাড়া মুখটাতে মুচকি হাসি দেখে সোনা-টিয়া অবাক!
উনুন থেকে লম্বা লম্বা জ্বলন্ত কাঠগুলোকে টেনে বের করে ফেলে, তাতে বালতি বালতি জল ঢেলে আগুন নিবিয়ে, কোমরের গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে ফেলে, হোটেলওলা কাঠের হাতা দিয়ে সুরুয়া থেকে দাড়িগোঁফ তুলে, বালতির জলে ধুয়ে অমনি গাছের ডালে শুকুতে দিল। আর ট্যাক থেকে আরেক জোড়া দাড়িগোঁফ বের করে নিল। তারপর সোনা-টিয়ার দিকে ফিরে ফিক করে হেসে বলল, আগে কেউ আমার সুরুয়া মুখে দিলেই ওয়াক থুঃ বলে ফেলে দিত আর রোজ পয়সা ফেরত চাইত। তারপর একদিন দাড়িগোঁফ আচমকা সুরুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে ওর সঙ্গে রান্না হয়ে গেল। আমি ভয়ে মরি, এবার ওরা আমার পিঠে চ্যালাকাঠ না ভেঙে ছাড়বে না! কিন্তু কী আর বলব, সেদিন সুরুয়া খেয়ে সবার মুখে সুখ্যাতি আর ধরে না, জাদুকর ওর নামই দিয়ে দিল স্বর্গের সুরুয়া– তোমরা যেন আবার দাড়িগোঁফের কথা কাউকে বোলো না, তাহলে আমাকে আর কেউ দেখতে পাবে না।