অমনি সোনা টিয়া লাফিয়ে উঠল, কোথায় জাদুকর, কখন খেলা হবে? মাকু বলল, তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে, দুধরুটি খেয়ে উঠলে তারপর!
টিয়া বলল, আকাশ থেকে পরিদের রানিকে নামাবে?
সোনা বলল, চুপ, বোকা!
মাকু একটু যেন ঘাবড়ে গেল। বলল, আচ্ছা, চল তো নীচে।
সোনা মাকুর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, না মাকু, না, পরিদের রানি ভালো না, আমরা দেখতে চাই না।
সং বলল, ওমা! চাই না আবার কী! একবার দেখলে মুভুটি ঘুরে যাবে, চল-না একবার। একবার একটি কলের মানুষ–
সোনা-টিয়া দু-জনে এইখানে দু-হাত দিয়ে সঙের কথা বন্ধ করে দিল। সং তো এমনি অবাক হল যে তার গাল থেকে দুটো বড়ো বড়ো আঁচিল খুলে পড়ে গেল। সেগুলোকে তুলে নিয়ে সঙ আবার যার যেখানে টিপে বসিয়ে দিল।
চাকরির কথা ভুলে গিয়ে সোনা-টিয়া খেতে বসে গেল, মাকু তাদের ডালের ওপর তুলে দিয়ে, কাজে লেগে গেল। সোনা-টিয়াকে ফিসফিস করে বলল, লোকের সামনে ওকে মাকু বলে ডাকিস নে, তাহলে ধরে নেবে।
আর সবাই কখন খেয়ে যে-যার নিজের কাজে চলে গেছে, বটতলার হোটেল খাঁ খাঁ করছে। মাকুকে হোটেলওলা বললে, ওরা খেতে বসুক, তুমি তিন জনের হয়ে খেটে দাও, কেমন? কী যেন নাম তোমার? তারপর সবাই মিলে জাদুকরের খেলা দেখা যাবে।
সোনা এক বার টিয়ার দিকে, এক বার মাকুর দিকে চেয়ে বলল, ওর নাম বেহারি। ও জাদুর খেলা দেখতে চায় না, টিয়া আর আমি দেখব, ও ঝরনায় বাসন ধোবে।
কিন্তু মাকু কিছুতেই রাজি হয় না, বলে, আমিও টপ করে কাজ সেরে নিয়ে জাদু দেখব। বেহারি বললে কেন?
টিয়া বলল, ছি, তাড়াতাড়ি করে বাসন ধোয় না, তাহলে ভেঙে যায়। বেহারি আমাদের বাড়িতে বাসন ধোয়।
মাকু বলল, কাঠের বাসন আবার ভাঙে নাকি? আমি খেলা দেখব, আকাশ থেকে পরিদের রানি নামানো দেখব। অমনি সোনা-টিয়ার সে কী কান্না। না, না, না, ও জাদু দেখবেনা। ও হোটেলওলা, ওকে যেতে বলল।
হোটেলওলা মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। দ্যাখো, বাপু, বনের মধ্যে বাঁশতলায় আমি খরগোশ ধরবার ফাঁদ পেতেছি, সেখানে গিয়ে তুমি বরং খরগোশ পড়ল কিনা দেখে এসো। বুড়ো হাবড়া, নাই-বা দেখলে জাদুর খেলা!
অমনি সোনা জানতে চাইল খরগোশ ধরা কেন, কী হবে খরগোশ দিয়ে?
শুনে সঙের কী হাসি! কী আবার হয় খরগোশ দিয়ে? কালিয়া হবে। মালিকের রান্না খরগোশের কালিয়া একবার খেয়ে দেখো!
সোনা-টিয়ার দম বন্ধ হয়ে এল। চাপা গলায় টিয়া বললে, কীরকম খরগোশ! সাদা? লাল চোখ? বলেই দু-জনে দু-হাতে চোখ চেপে ধরে হাপুসনয়নে কাঁদতে বসে গেল। সং বললে, ভ্যালা রে দামোদর নদী! আরে না, না, সব খরগোশ কি আর সাদা হয়? কী বলো মালিক?
হোটেলওলা মাকুকে বললে, দ্যাখো, বেহারি, সাদা খরগোশ পেলে দু-টি এনো, এরা পুষবে; বাকি ছেড়ে দিয়ো। আর কালো কুচ্ছিত দুষ্টু খরগোশ পেলে আমাকে দিয়ো, কালিয়া রাঁধব। আহা, দুষ্টু কালো খরগোশের কালিয়া যে না খেয়েছে তার জন্মই বৃথা!
মাকু ওদের কানে কানে বলল, কোনো ভয় নেই, সাদা খরগোশ আমি সব ছেড়ে দেব। টিয়া বললে, সব ছাড়বে না মোটেই, দিদি আর আমি দুটোকে পুষব। আমারটার নাম গঙ্গা, দিদিরটার নাম যমুনা। সোনা বললে, দুৎ, আমারটার নাম গঙ্গা, তোরটার নাম যমুনা। এই বলে দিল টিয়ার কান ধরে এক টান! টিয়া কাদবে বলে হাঁ করেছে, ঠিক সেই সময় হট্টগোল করতে করতে ঝুড়ি-ঝোড়া দলবলসুদ্ধ জাদুকর এসে উপস্থিত। মাথায় লম্বা চোঙার মতো টুপি, গায়ে, চকরা-বকরা মাটি অবধি ঝোলা জামা, তার ঢলঢলে হাতা। সোনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
–ও টিয়া, ও টিয়া, জামার হাত থেকে কেমন বড়ো বড়ো রাজহাঁস বেরোয় দেখেছিলাম, মনে নেই? তারপর মাকুর দিকে ফিরে বলতে যাবে, রাজহাঁস বেরুনো দেখে যাও, মাকু, কিন্তু মাকু ততক্ষণে চলে গেছে।
জাদুকর গোছগাছ করছে, দু-চারজন দর্শকও এসে জুটেছে, এদিকে হোটেলওলা হন্তদন্ত হয়ে গাছের গোড়ায় কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। সোনা জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছে বলোনা? টিয়া একবার বাপির গাড়ির চাবি খুঁজে দিয়েছিল। টিয়া খুশি হয়ে গেল। সেই যে আম্মার মশলার কৌটো খুঁজে দিয়েছিলাম মোড়ার তলা থেকে! অমনি আম্মার কথা মনে পড়াতে দু-জনার গলা টনটন করে উঠেছে। তাদের চোখে জল দেখে, হোটেলওলা বললে, ছি, কাঁদে না, আজ যে আমার জন্মদিন, আজ রাতে ভোজ হবে, ঘাসজমিতে সার্কাস হবে, তাই এরা এত মওড়া দিচ্ছে, তাও জান না?
শুনে সোনা টিয়া মহা খুশি। তার দাড়িতে চুমু খেয়ে ওরা বললে, তা হলে কী দেব তোমার জন্মদিনে?
টিয়া পুঁটলি খুলে একটা ছোটো কচি বের করে বলল, এইটা নাও, তোমার জন্মদিনে, মেহের সোনা–টিয়া।
সোনার চোখ গোল হয়ে গেল। ওমা, টিয়া কী দুষ্টু মেয়ে, এইটা-না মামণির নখ কাটার কাচি, মামণি যদি রাগ করে?
–ছি, টিয়া, মামণির কঁচি নেয় না। হোটেলওলাও ব্যস্ত হয়ে উঠল, না, না, কঁচি দিয়ে আমি কী করব?নখফক আমি আদপেই কাটি না। তার চেয়ে বরং আমার হারানো জিনিসটা খুঁজে দিয়ে কেমন? সেটা না পেলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ওরা ওকে ঘেঁকে ধরল, কী হারানো জিনিস বলল মালিক! হোটেলওলা বললে, এখন নয়, জাদু খেলার পর, দুপুরের রান্না চাপাব, তোমরা আলু সেদ্ধর খোসা ছাড়িয়ে দেবে, তখন বলব। এখন খেলা দেখো, নইলে ওরা মকশো করবেনা, তাহলে সব ভুলে যাবে, সার্কাশে খেলা দেখাতে পারবে না, খেতে পাবে না ওরা তখন। সবাই শুকিয়ে মরে যাবে। এই বলে দাড়ি দিয়ে মালিক একবার চোখ মুছে নিল।