হোটেলওলা হেসে বলল, তা খুব ভালো তো। কিন্তু এখানে তোমাদের রাঁধতে হবেনা, উনুনের নাগালই পাবে না, তোমরা খাবার জায়গা করবে, বাটি ধুয়ে দেবে, ঝটপাট দেবে, কেমন?
তারপর মাকুর দিকে ফিরে বলল, তুমিও কাজ করতে পারবে নাকি? টিয়া অমনি বলল, ও সব পারে, অঙ্ক কষতে পারে, সেলাই কল চালাতে পারে, পেরেক ঠুকতে পারে, ওর পেটে কল– উঃ! টিয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মাকু ব্যস্ত হয়ে উঠল, কী হয়েছে টিয়া, ঘুম পেয়েছে?
সোনা বললে, না, না, টিয়া কাঁদে না, আয় তোকে চুমু খাই। ভুলে চিমটি কেটেছি রে। এই নে, খাবার খা।
টিয়া অমনি ফিক করে হেসে ফেলল। হোটেলওলা বলল, খাবে-দাবে, আমার গেছো-ঘরে শোবে, পয়সাকড়ি লাগবে না। গাছের ধারের ছোটো ঝরনায় চান করবে, কাপড় কাচবে, বাসন ধোবে, কেমন? আমিও বাঁচব, তোমরাও বাঁচবে। দিনে দিনে ব্যাবসা যেমন কেঁপে উঠছে, একা হাতে চলছে না।
এই বলে মুচকি হেসে হোটেলওলা ফতুয়ার পকেট চাপড়াল, অমনি ভেতর থেকে পয়সাকড়িও ঝনাৎঝনাৎ বেজে উঠল। সোনা-টিয়া ভয়ে ভয়ে দু-টুকরো হাতরুটি সুরুয়াতে ডুবিয়ে মুখে তুলল।
খাসা সুরুয়া, এত ভালো সুরুয়া সোনা-টিয়া জন্মে কখনো খায়নি। বাড়িতে যেদিন সুরুয়া হয় ওরা দু-জন মহা কাঁও-ম্যাও করে। এ অন্য জিনিস, মাকুও দু-হাতে বাটি তুলে লম্বা লম্বা টান দিতে লাগল। ওদের পাশেই কতকগুলো রোগা লোক চেটেপুটে সুরুয়া খেয়ে বলল, সাধে এর নাম হয়েছে স্বর্গের সুরুয়া! এমন সুরুয়া আর কেউ বানাক দেখি!আগের মালিক রাবিশ রাঁধত, সবাই রেগে যেত। হঠাৎ একদিন ভোল বদলে গেল, সবাই খুশি! অথচ মালিক এমনি চালাক যে কাউকে শেখাবে না। তার মানে সব শেখাবে, খালি শেষের পাটে লুকিয়ে লুকিয়ে কী যে মশলা ঢালে, সেটি কাউকে বলবে না।
আরেক জন হাতরুটি দিয়ে বাটির তলা মুছে, টুকরোটা মুখে ফেলে বলল, আজকাল কিন্তু এত ভালো রাঁধে যে নিজের হোটেলে নিজে খায়। আগে খেত না, বলত, ওসব খেয়ে যদি আমার ব্যামো হয়, তখন তোদের জন্য রাঁধবে কে শুনি?ওর জন্য তখন জাদুকর রোজ খিচুড়ি বানিয়ে দিত। এখন এখানেই খায়।
তাই শুনে হোটেলওলা হেসে বলল, তা আর খাব না? এত ভালো খাবার আর কোথায় পাব, সেইটে বল? তা ছাড়া, এ-রকম না করলে আমার পয়সা জমবে কী করে? জাদুকর কান মুচড়ে টাকা নিত না? এখন নিজের হোটেলে মিনিমাগনা থাকি খাই আর লাভের টাকা গুণে তুলি। টাকার যে আমার বড়ো দরকার!
তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে রোগা লোকেদের তাড়া দিতে লাগল, নে, নে, এবার ওঠ দিকি, শোবার আগে একবার খেল মকশো করতে হবেনা! শেষটা গায়ে এমনি গতর লেগে যাবে যে আর দড়াবাজির খেলা দেখাতে হবে না, এখন ওঠ দেখি সব।
অমনি ঝুপঝাপ করে যে-যার গাছের ডাল থেকে নেমে পড়ল। নিমেষের মধ্যে তক্তা তুলে গুঁড়ি হটিয়ে, তারা অনেকখানি ফাঁকা জায়গা করে নিল। সেখানে মগডাল অবধি উঁচু যেন সার্কাসের তাবুর ছাদ। সর সর সর করে জনা পাঁচেক ডালপালা বেয়ে উঠে পড়ল। ওপরে কোথায় যেন দড়িদড়া গোঁজা ছিল, দেখতে দেখতে টান করে দড়ি বাঁধা হয়ে গেল, তার দু-মাথা থেকে দুটো দোলনা ঝুলতে লাগল।
সোনা-টিয়া তো হাঁ, চোখ থেকে ঘুম কোথায় পালিয়ে গেল। মাকুকে খোঁচা দিয়ে বলল তারা, দ্যাখ, মাকু, দ্যাখ, মগডাল থেকে উলটো হয়ে ঝুলছে কেমন দ্যাখ রে! সত্যি সত্যি এক জনের হাত ধরে এক জন ঝুলে নিমেষের মধ্যে নীচের মাটিতে যারা ছিল তাদেরও টপটপ করে ওরা তুলে নিল। তারপর হোটেলওলা তাল দিতে লাগল আর দড়ির ওপর সে যে কত দৌড়, কত ঝাঁপ, কত ডিগবাজি, কত নাচ! চমকে গিয়ে জিব কামড়ে মাঝখানে টিয়া একটু কেঁদে নিল, তারপরে ওপর থেকে ঝুপঝাঁপ করে এক জনের পিঠে এক জন যেমনি নেমে পড়ল টিয়াও না হেসে পারল না।
খেলা শেষ হলে হোটেলওলা ওদের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে বলল, মকশো না করলে কি চলে? ওরা সার্কাসের লোক, বিদ্যে ভুলে গেলে খাবে কী? খুঁচিয়ে তাই অভ্যাস করাই। এবার চলো, গেছো-ঘরে শোবে চলো, চোখ তোমাদের জড়িয়ে আসছে।
ছোটো একটি হাইতুলে সোনা বলল, বাসন পোবনা? আমার তোমার চাকর-না? হোটেলওলা সোনাকে টপ করে কোলে তুলে বলল, তোমাদের যে এক বেলার চাকরি। দু-বেলা চাকর রাখার সংগতি কোথায় আমার? তারপর মাকুকে বলল, নাও, টিয়াকে নিয়ে চলো।
গাছের গায়ে সিঁড়ির মতো খাঁজ কাটা; আট-দশটা ধাপ উঠতেই ডালপালার মধ্যে কাঠের তক্তা দিয়ে কী সুন্দর ঘর। বাতাস বইলে দোলনার মতো দোলে; শুকনো পাতার ওপর নীল চাদর বিছানো; পুঁটলি মাথায় দিয়ে শোবামাত্র সোনা-টিয়ার ঘুমে চোখ বুজে এল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে মাকু যদি পালায়; অন্ধকারে ঘোর জঙ্গলে, হঠাৎ চাবি ফুরিয়ে এলিয়ে পড়লে, শেয়ালে কিংবা খরগোশে যদি মাকুকে টেনে নিয়ে যায়? যেন মনে হল মাকু ঘুমিয়েছে, পুটলির মুখের বড়ো সেফটিপিন দিয়ে নিজের ফ্রকের সঙ্গে সোনা মাকুর জামার কোণটি এঁটে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মাকুর রাতে পালানো বন্ধ হল।
দখিন হাওয়ার দোল খেয়ে খেয়ে সারারাত সোনা টিয়া ঘুম দিল, জাগল যখন সকাল বেলায় পাখির গানে কান ঝালাপালা হল আর ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চোখে এসে লাগল।
চোখ খুলেই সোনা দেখে সর্বনাশ হয়ে গেছে, সেপটিপিন দিয়ে ফ্রকের সঙ্গে আঁটা মাকুর জামাটা পড়ে আছে, কিন্তু মাকু নেই! মাকু, মাকু করে কেঁদে ফেলল সোনা। তাই শুনে মাকু, মামণি, বাপি, আর আম্মার জন্যে টিয়াও মহা কান্না জুড়ে দিল। কান্না শুনে গাছ বেয়ে মাকু, হোটেলওলা, সং আর সাতজন দড়াবাজির ওস্তাদ ওপরে উঠে এল। সং বলল, ধ্যেৎ, তোদের মতো বোকা তো আর দেখিনি। চাকরটা কি হাতমুখও ধোবেনা, খাবেদাবেও না নাকি? এক্ষুনি জাদুকরের জাদু হবে আর তোরা চাঁ ভ্যাঁ করছিস! এরা কী রে!