সবার পেছনে সং, তার পাশে সোনা-টিয়াকে কোলে করে মাকু। এই সময় টুপ করে সূর্যটা বোধ হয় ডুবে গেল, চারদিকে হঠাৎ ধাঁ করে অন্ধকার নেমে এল। সোনা-টিয়ার আর মাকুর কোল থেকে নামবার কথা মনে হল না। মাকু তো কলের মানুষ। তার মোটেই দুটো ধাড়ি ধাড়ি মেয়ে কোলে করলেও হাত ব্যথা করে না।
তবু কিন্তু মাকুর যেন একটু হাঁপ ধরে যাচ্ছে মনে হল, অমনি খচমচ করে সোনা টিয়া কোল থেকে নেমে পড়ল। এইখানে দম ফুরিয়ে গেলেই তো হয়ে গেল। কানখুশকিও আনা হয়নি যে আবার দম দিয়ে দেবে। তা ছাড়া অন্ধকারে চাবির ছাদাই-বা খুঁজে পাবে কী করে? তার ওপর একটু দূরেই আলো দেখা যাচ্ছিল। মাকু বলল, ও কী হল? নেমে পড়লে যে?
সোনা একবার টুক করে তার মুখটা দেখে নিয়ে বলল, কোলে উঠলে আমার পা কামড়ায়।
টিয়া হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল, খাবার সময় হয়ে গেছে। সোনা এখন কী করে? পুটলির খাবার তো শেষ, ঝেড়ে দেখে খাগড়াগুলোর কিছু বাকি রাখেনি মাকু। টিয়ার চোখ মুছিয়ে চুমু খেয়ে সোনা বলল, না, না, কাঁদে না টিয়া। মাকু আমাদের জন্য খাবার এনে দেবে! দেবে না, মাকু?
মাকু বললে, সং, খাবার কোথায় পাওয়া যায়?
সং বললে, কেন, বটতলার সরাইখানায়। আমরা সবাই তো সেখানেই খাই। কিন্তু নগদ পয়সা দিয়ে খেতে হয়। সরাইওলা বাকিতে কিছু দেয় না, ওরনাকি বড্ড টাকার দরকার। তোমাদের পয়সা আছে তো খুকিরা?
সোনা বলল, আমার নাম সোনা, আমার দু-বছর, আর ওর নাম টিয়া, ওর পাঁচ বছর। আমার কাছে একটা পয়সা আছে; ও ছোটো, ও কোথায় পাবে?
সং তাই শুনে হো হো করে হাসতে লাগল। এক পয়সায় একটা কাঁচা লঙ্কাও দেয় যদি সরাইওলা, সেই যথেষ্ট! ব্যাটা টাকার জোঁক, কিন্তু রাঁধে খাসা!
টিয়া আবার বলল, খাবার সময় হয়ে গেছে। আমরা এখন খাই। সোনার গলার কাছটা আবার ব্যথা করতে লাগল। মাকু দু-জনার পিঠে দুটি হাত রেখে বলল, কোনো ভয় নেই। চলো, কী খাবার আছে দেখা যাক, আমি পয়সা দেব।
সোনা বললে, পয়সা কোথায় পেলে, মাকু? মাকু বললে, কেন, আমি করেছি, আমি অনেক পয়সা করি।
সোনা বলল, তুমি নাচ, গাও, সাইকেল চালাও, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দাও, আবার পয়সাও করতে পার?
মাকু বললে, হুঁ, পয়সা করতে পারি, গোলমাল করতে পারি, হইচই করতে পারি। চলো, এবার বটতলায় সরাইখানায় গিয়ে কিঞ্চিৎ হইচই করা যাক।
সং যে কখন ওদের ফেলে হনহন করে এগিয়ে গেছে তা কেউ লক্ষ করেনি। মাকুও দু-জনার পুটলিসুদ্ধ হাত ধরে এবার আলোর দিকে এগিয়ে চলল। দূরে কোথাও হুতুমথুম হুতুমথুম করে প্যাঁচা ডাকতে লাগল, কিন্তু সোনা-টিয়ার একটুও ভয় করল না। এমনি করে একটু চলেই ওরা বটতলার সরাইখানায় পৌঁছে গেল।
০৩.
হোটেল বলে হোটেল! সে এক এলাহি ব্যাপার! গাছ থেকে খানকতক বড়ো বড়ো লণ্ঠন ঝুলছে; গাছের গোড়ায় তিনটি পাথর বসিয়ে প্রকাণ্ড উনুন হয়েছে, তার গনগনে আগুনের ওপর মস্ত পেতলের হাঁড়িতে টগবগ করে কী যেন ফুটছে, চারদিক তার সুগন্ধে মো-মো করছে। মাথার ওপর ডালপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো গলে আসে,শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা মাটিতে কোথাও ফুটফুট করছে, আবার কোথাও ঘন কালো ছোপ ছোপ ছায়া দেখা যাচ্ছে।
হোটলের ছিরি কত! বট গাছের নীচু নীচু ডালে রাজ্যের লোক সারি সারি পা ঝুলিয়ে বসে। এখান দিয়ে ওখান দিয়ে, মাঝখান দিয়ে রাশি রাশি ঝুরি নেমেছে, তাই মুখগুলো তাদের ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কাপড়-জামাগুলোকে কেমন যেন রং-বেরং অদ্ভুত মনে হচ্ছে। গাছের গুঁড়ির ওপর কাঁচা কাঠের তক্তা ফেলে খাওয়া-দাওয়া চলেছে। তার গন্ধে সোনা-টিয়ার জিবে জল এল।
হাতা হাতে হোটেলওলা, মুখভরা তার ঝুলো গোঁফ আর থুতনি ঢাকা ছাই রঙের দাড়ি, দেখে মনে হয় যেন ধোপার বাড়ি থেকে ফিরেছে। সোনা-টিয়ার বড়ো হাসি পেল। লোকটা কিন্তু বড়ো ভালো, ওদের দেখেই হাতা উঁচিয়ে ডাক দিল, এসো এসো, এইখানে বসে যাও, পেট ভরে খাবার খাও, নিজের হাতে বেঁধেছি।
সোনা-টিয়াকে গাছের ডালে তুলে দিতে হল, শূন্যে তাদের ঠ্যাং ঝুলতে লাগল, মাকুও ওদের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসল, তার প্রাণে যে বড়ো ভয়। টিয়া তার কানে কানে সাহস দিয়ে বলল, কোনো ভয় নেই, মাকু, দিদি সব ঠিক করে দেবে। তুমি আমার এই রুমালটা হাতে ধরে রাখতে পার। বড়ো বড়ো গোলাপ ফুলের নকশাকাটা ছোটো একটি রুমাল টিয়া পুটলি থেকে বের করে ওর হাতে গুঁজে দিল।
হোটেলওলা টিনের মগে জল এনে বলল, খাবার দিই? তার আগে হাত ধুয়ে ফেলো, কেমন?
মাকু হঠাৎ বললে, কী কী আছে?
হোটেলওলা চটে কাঁই! কী কী আছে আবার কী? রোজ রাতে যা থাকে তাই আছে, অর্থাৎ স্বর্গের সুরুয়া আর হাতের রুটি। একবার চেখে দেখলে অন্য কিছু খেতেও ইচ্ছে করবে না।
এই বলে তিনটে বড়ো কাঠের বাটিতে সুরুয়া আর শালপাতাতে এক তাড়া হাতরুটি নিয়ে এল।
সোনা বললে, আমাদের বেশি পয়সা নেই, আমাদের কম খেতে দিয়ো। টিয়া, কম করে খাস।
হোটেলওলা বলল, বালাই, ষাট! কম খেতে দোব কেন? পেট ভরে খাও, এত ভালো কেউ রাঁধতে পারে না, এ আমি নিজেই বলে দিলাম। নাও, ধরো, পয়সাকড়ি কিছু দিতে হবেনা, তোমরা বরং আমার হোটেলের কিছু কিছু কাজ করে দিয়ো, একা একা আর পেরে উঠি নে।
টিয়া খুশি হয়ে গেল। আমরা পুতুলদের জন্যে কাদা দিয়ে ভাত বানাই। গাঁদা ফুলের পাতা দিয়ে দিদি মাছ রান্না করে।