যতই বনের ভেতর যায়, ততই গাছপালা ঘন হয়ে আসে, আলো কমে যায়। দৌড়োতে দৌড়োতে শেষটা পায়ে ব্যথা ধরে গেল, ফ্রকে রাশি রাশি চোরকাটা ফুটল, জল তেষ্টা পেতে লাগল। এমনসময় সোনা-টিয়া দেখল গাছের নীচে টলটল করে বয়ে চলেছে এতটুকু একটা নদী। কী পরিষ্কার তার জল, তলাকার নুড়ি পাথর কেমন চকচক করছে দেখা যাচ্ছে, কী সুন্দর একটা ছলছল, ঝরঝর শব্দ কানে আসছে। নদীর ধারেই একটা বড়ো কালো পাথরে ঠেস দিয়ে সোনা-টিয়া বসে পড়ল।
ছোট্ট নদী, তাতে একহাঁটু জলও নেই। সোনা-টিয়া পুটলি নামিয়ে আশ মিটিয়ে হাতমুখ ধুল, পা ডোবাল, আঁজলা আঁজলা জল তুলে খেল, ফ্রক ও ইজের ভিজে একাকার! তারপর খিদে পেয়ে গেল। পুঁটলি খুলে ঠামুর ঘরের বড়ো পান খেল দুটো দুটো করে। কখন ঘুম পেয়ে গেছে খেয়াল নেই, কালো পাথরের আড়ালে পুটলি মাথায় দিয়ে দুজনার সে কী অসাড়ে ঘুম!
মটমট করে কাদের পায়ের চাপে কাঠকুটো ভাঙার শব্দে তবে ঘুম ভাঙল।
চেয়ে দেখে নদীর ওপারে সরু নালামতো জায়গা বেয়ে জানোয়াররা জল খেতে আসছে। প্রথমে দুটো ঘোড়া, তাদের তাড়িয়ে আনছে টুপিপরা দুটো বাঁদর, তাদের পেছনে গলায় ঘন্টা বাঁধা একটা ছাগল, তার পেছনে পর পর দুটো মোটা মোটা কালো ভাল্লুক, তার পেছনে গোটা ছয় কোঁকড়ালোম ছোটা কুকুর, সবার শেষে রঙচঙে লাঠি হাতে আধখানা লাল আধখানা নীল পোশাক পরা সত্যিকার একটা সং।
নিমেষের মধ্যে জায়গাটা টুংটুং, কিচমিচ, ঘোঁৎ ঘোঁৎ, খেউ খেউ শব্দে একেবারে ভরপুর হয়ে উঠল। অবাক হয়ে সোনা-টিয়া উঠে দাঁড়িয়ে নদীর একেবারে কিনারায় এল। ঠিক সেই সময় চাপা গলায় কে বলল, স্স্-এই, পুটলি ফেলে গেলে পিঁপড়েতে খেয়ে ফেলবে। খাগড়াইগুলো খাসা। এই বলে একটা পরিষ্কার রুমাল বের করে লোকটা মুখ মুছে ফেলল।
সোনা-টিয়ার গায়ে কাঁটা দিল। এই তবে মাকু! এ যে মাকু সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কেমন লম্বা সটাং চেহারা, গায়ের মাংসগুলো আঁটোসাঁটো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্ল্যাস্টিক আর রবার দিয়ে তৈরি, মাথায় কোঁকড়া চুল, ছাই রঙের চোখ আর নাকের ডগায় এই মস্ত একটা কালো তিল। ঠিক ঘড়িওলা যেমন বলেছিল! নাঃ, একে আর ছাড়া নয়, কখন চাবি ফুরিয়ে যাবে তার ঠিক কী, শেষটা দুষ্টলোক হাত-পা কলকজা খুলে নিয়ে চলে যাবে, তখন ঘড়িওলা বেচারি আর মাকুর খেলা দেখিয়ে পয়সা করে, বড়োলোক হতে পারবে না।
টিয়া এসব কিছুই নজর করেনি, সে হাঁ করে জানোয়ারদের জল খাওয়া দেখছিল। নদীর কিনারা ধরে তারা সারি সারি মুখ নীচু করে অনেকক্ষণ জল খেল! কী সুন্দর একটা চকর-বকর গবর-গবর শব্দ হতে লাগল।
তখন আলো কমে এসেছে, একটু বাদেই সূর্য ডুবে যাবে। জল খেয়ে মুখ তুলে সঙ তাদের দেখতে পেল। অমনি দুহাত দিয়ে মুখের চারদিকে চোঙা বানিয়ে ডেকে বলল, আমাদের অধিকারী মশাইকে দেখেছ? তোমরা কে?
মাকু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, সোনা তার গা টিপে বলল, চুপ, কিছু বোলো না মাকু, চাবি ফুরুলেই তোমার হাত-পা খুলে নিয়ে যাবে! ধরা পড়ে দারুণ চমকে গিয়ে, কট করে মাকু মুখটা বন্ধ করে ফেলল। ভেতরে যে কজা দেওয়া সেটা বেশ বোঝা গেল।
সোনা নিজেই বলল, আমরা সোনা টিয়া, প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল খুঁজতে এসেছি। ও আমাদের বন্ধু। তোমরা কে?
সং বলল, আমরা সার্কাসপার্টির আধখানা। অধিকারী মশাই মাঠের ভাড়া, তবুআর গ্যাসবাতির দাম না দিয়েই পালিয়ে গেছে, তাই আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কত বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল চাও?
টিয়া দু-দিকে দু-হাত মেলে দিয়ে বলল, এই এত বড়ো। পিসির খোকার পুতুলের চেয়েও ঢের ঢের বড়ো।
সং বলল, তাহলে চলো আমার সঙ্গে। সোনা তো অবাক। তোমার কাছে আছে?
না, কিন্তু চেষ্টা করলে জোগাড় করতে পারি। আমাদের সার্কাসের জাদুকর কী না করতে পারে! খালি টুপির ভেতর থেকে পাতিহাঁস বের করে, চোখের সামনে ওই ছাগলটাকে হাওয়া করে দেয়, শূন্যে ফঁস দিয়ে পরিদের রানিকে নাবিয়ে এনে, একসঙ্গে জোড়া ঘোড়ায় চাপায়।
আড়চোখে একবার মাকুর দিকে তাকিয়ে সোনা বলল, চলো, আমরা তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু কী করে নদী পার হব, পাথর যে বড়ো পিছলা? তুমি এসে আমাদের পার করে দাওনা।
সং বলল, ও বাবা! সে আমি পারব না। তোমরা বেজায় ভারী।
সোনা বলল, না, না, আমরা একটা করে পা শূন্যে ঝুলিয়ে রাখব তাহলে আর ভারী লাগবেনা। পুঁটলি দুটো পরে নিয়ে যেয়ো।
সং কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না। না, শেষটা, যদি আমার নতুন পেন্টেলুনের রং গলে বিতিকিচ্ছি হয়ে যায়। তার চেয়ে তোমাদের বন্ধুই তোমাদের পার করুক-না কেন? বেশ তো পুরুষ্টু আছে দেখতে পাচ্ছি।
সোনা তাই শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল, না, না মাকু, জল লেগে যদি তোমার জোড়ার আঠা ধুয়ে যায়, তখন হাত-পা জলে ভেসে যাবে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাকু একগাল হেসে বলল, কিছু ভয় নেই, হাত-পা আঠা দিয়ে জোড়া হবে কেন? সেরা কারিগরের হাতের কাজ; একসঙ্গে ছাঁচে ঢালাই করা। ওঠো আমার কোলে।
এই বলে মাকু টপ করে পুঁটলিসুদ্ধ দুজনকে দু-কোলে তুলে দিব্যি সুন্দর নদী পার হয়ে গেল। জন্তুরা এতক্ষণ যে-যার চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার তারাও আগের মতো সারি বেঁধে বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ ধরে এগিয়ে চলল।