ঘড়িওলাও চোখ মুছল। তাই কি হয়, দিদি, মাকু যে আমার প্রাণ, ওকে নাগালের বাইরে যেতে দিই কী করে? ওর চাবি ফুরিয়ে গেলেই যে নেতিয়ে পড়বে, তখন চোর-ডাকাতে ওর কলকজা খুলে নিলেই মাকুর আমার হয়ে গেল।
কবে চাবি ফুরুবে?
–এক বছরের চাবি দেওয়া, তার সাড়ে এগারো মাস কেটে গেছে, আর পনেরো দিন। বলল, ওকে বের করে চোখে চোখে রাখবে?
সোনা বললে, সেলাই কল চালায় আর নিজের পেটের চাবিটা ঘুরিয়ে নিতে পারবে না?
ঘড়িওলা ব্যস্ত হয়ে উঠল। পেটে নয়, দিদি, পেটে নয়, পিঠের মধ্যিখানে, গায়ে-বসা এত্তোটুকু চাবি, কানখুসকি দিয়ে ঘুরুতে হয়। নইলে মাকু যা দস্যি, কবে টেনে খুলে ফেলে দিত! ওখানে সে হাত পায় না, হাত দুটো ইচ্ছে করে একটু বেঁটে করে দিয়েছি।
কথা বলতে বলতে কখন তারা শুনশুনির মাঠ পেরিয়ে এসেছে, সামনে দেখে ঘন বন। বনের মধ্যে খানিক রোদ, খানিক ছায়া, পাখির ডাক, পাতার খসখস, বুনো ফুলের আর ধূপ কাঠের গন্ধ। ঘড়িওলা বললে, আমি আর যাব না, মাকু আমাকে দেখলে ঘেঁকে ধরবে, আমার ভয় করে। তোমরা স্কুলে ভরতি হয়েছ, ভয় পাও না, তোমরা যাও! আমি এখানে গাছের মাথায় পাতার ঘর বেঁধে অপেক্ষা করি। এই বলে ঘড়িওলা সোনা-টিয়ার ঘাড় ধরে একটু ঠেলে দিল।
০২.
ঠেলা খেয়ে প্রায় একরকম ঢুকেই গেছিল বনের মধ্যে সোনা আর টিয়া, এমনসময় ঘড়িওলা পেছন থেকে ডেকে বলল, চললে কোথা? হ্যাঁন্ডবিল নিতে হবে না? তা নইলে মাকুর বিষয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জানবে কী করে? বলি, তাকে চিনতে হবে তো?
এই বলে ঝোলা থেকে একটা বড়ো মতো গোলাপি কাগজ বের করে, পাশের মাটির ঢিপির ওপর চড়ে গলা খাঁকরে পড়তে লাগল–
মাত্র পঁচিশ পয়সায়!
অদ্ভুত! অত্যাশ্চর্য!!
মাকু দি গ্রেট!!!
অভাবনীয় দৃশ্য দেখে যান!
কলের মানুষ চলে ফেরে, কথা কয়, অঙ্ক কষে, টাইপ করে, সেলাইকল চালায়, হাতুড়ি পেটে, রান্না করে, মশলা বাটে, বাসন ধোয়, ঘর মোছে, হারানো জিনিস খুঁজে দেয়, নাচে, গায়, সাইকেল চাপে, দোলনা ঠেলে, পরীক্ষার প্রশ্নের জবাব দেয়!
এই অবধি পড়ে ঘড়িওলা মাটির ঢিপির ওপরে বসে মাকুর শোকে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল! তাই দেখে টিয়াও মহা কান্না জুড়ে দিল। সোনা পড়ে গেল মুশকিলে, কাউকে কাঁদতে দেখলেই তার গলায় কেমন ব্যথা ব্যথা করে, অথচ তাহলে এদের দুজনকে থামায় কে? অনেক কষ্টে টিয়ার মুখে মুড়ি লজেঞ্জুস পুরে আর পুঁটলির গেরো দিয়ে ঘড়িওলার চোখ মুছে তাদের ঠান্ডা করে, সোনা বলল, কী, হয়েছে কী? সবটা পড়তে পারছ না বুঝি? ঘড়িওয়ালা মাথা নাড়ল। না,, বাকিটা লেখাই হয়নি। মাকু যেই পালিয়ে গেল, অধিকারী বলল, আর কালি খরচ করে কী হবে, ওকে আগে ধরে আনা হোক! আমার আর তাই বড়োলোক হওয়া হল না। এই বলে ঘড়িওলা দু-তিন বার ফোৎ ফোৎ করে নাক টেনে নিল।
সোনা অবাক হয়ে গেল। টিয়াও হ্যাঁন্ডবিল দিয়ে চোখ মুছে বলল, কেন পালিয়ে গেল?
তা পালাবে না? আমি যেই পালালাম, ও আমাকে খুঁজতে না বেরিয়ে ছাড়ে কি! এতটুকু এক কুচি লোহা, কী টিন, কী তামা, কী পিতল, কী সোনা, কী রুপো যাই থাকুন-না কেন, যতই-না লুকোনো জায়গায়, মাকু তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। ওর হাতের পায়ের নখের তলায় একরকম রাডারযন্ত্র লাগিয়ে রেখেছি যে! এখন নিজেই তাই টিনের বোতাম কেটে, হাতঘড়ি ফেলে, ঘড়ি সারাবার যন্ত্রপাতি ছেড়ে, কতকগুলো কাপড় আর কাগজ আর কাঠ নিয়ে ফেরারি হয়ে, ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা আলপিন তুলতে সাহস পাচ্ছি না।
এই বলেই হঠাৎ চমকে লাফিয়ে উঠল সে, নাঃ, এখানে বসে থাকা একটুও নিরাপদ নয়, কখন সে এসে-না জাপটে ধরে আবার ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে,-পরিদের রানিকে বিয়ে করব, কঁদবার কল দাও, চোখ থেকে জল ফেলো! ভ্যালা গেরো রে বাবা! আর দেখো, সুন্দর লালচে কোকড়া চুল, ছাই রঙের চকচকে চোখ আর নাকের ডগায় কালো তিল দিয়ে মাকুকে চিনবে। কিন্তু সাবধান! তিলের নীচে টেপা সুইচ আছে।
এই বলেই এক ছুটে ঘড়িওলা শুনশুনির মাঠ পার হল। সোনা গোলাপি হ্যাঁন্ডবিলটা তুলে নিয়ে পুটুলিতে গুঁজে, টিয়ার হাত ধরে, আস্তে আস্তে বনের মধ্যে ঢুকল। কী ভালো বন, এই বড়ো বড়ো গাছগুলো মাথার ওপর তাদের ডালপালা দিয়ে সবুজ শামিয়ানা বানিয়ে রেখেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে এখানে-ওখানে কুচিকুচি রোদ এসে পড়েছে, গাছগুলোর পায়ের কাছে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, দিব্যি সুন্দর গালচে তৈরি হয়েছে। ছোটো ছোটো ঝোপেঝাড়ে কত রঙের ফুল ফুটেছে, একটা মিষ্টি মিষ্টি সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে, চারদিকটাতে কী ভালো একটা সবুজ আলো ছড়িয়ে আছে!
কিন্তু সোনা-টিয়াকে ফুল তুলতে দিল না। বলল, ফুল তুলতে গিয়ে দেরি করলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, নেকড়ে বাঘ বেরুবে।
টিয়া ফুল না তুলে পট করে একটা সবুজ পাতা ছিঁড়ল। সোনা অমনি পাতাটা কেড়ে ফেলে দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, চুপ, কিচ্ছু বি না, যদি বিষ পাতা হয়। টিয়া একটা ছোট্ট নুড়ি তুলে ঝোঁপের মধ্যে ছুঁড়ে মারল। অমনি সোনা দিল এক ধমক, ঠিল খেয়ে যদি কেউটে সাপ ফোঁস করে ফণা তোলে!
টিয়া আবার ভ্যা করে কাঁদতে যাচ্ছিল, অমনি সোনা তার হাত ধরে দৌড়োতে লাগল– চল, চল, চাবি ফুরোবার আগে মাকুকে খুঁজে বের করতে হবে-না?মাকু কেমন নাচবে গাইবে, আমাদের জন্য গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দেবে। দু-জনে দৌড়তে লাগল।