টিয়া হঠাৎ খচমচ করে মালিকের কোল থেকে নেমে পড়ে, দু-হাত তুলে মা-মা-মা বলে এলোপাথাড়ি দৌড়োতে লাগল। সোনাও দু-হাতে ঠোঁট চেপে জাদুকরের কোল থেকে নেমে, অন্ধের মতো এগাছে ওগাছে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটল। কী? হল কী? এমন সময় বটতলার ভিড়ের মধ্যে গোলাপি শাড়িপরা কেজন সুন্দর মানুষ খুন্তি নামিয়ে, দৌড়ে এসে দু-হাত বাড়িয়ে, দু-জনাকে বুকে চেপে ধরলেন। মামণি, মামণি, মামণি। এক-গোছা মাটির থালা মাটিতে নামিয়ে মোটাসোটা লম্বা যে লোকটি হাসি হাসি মুখ করে কাছে এলেন, সেই যে বাপি তা আর কাউকে বলে দিতে হল না।
তখন কী আদর, কী হাসি, কী গল্প, সে আর মুখে বলা যায় না। তারই মধ্যে ঝুপ করে পানের চুপড়ি নামিয়ে হাউমাউ করে ছুটে আম্মা এসে হাজির, ওদের দেখে তার পায়ের গুলো একেবারে সেরে গেছে। সবাই মিলে জড়াজড়ি করে তখন সে কী হট্টগোল, বাড়ি থেকে পালানোর জন্যে সোনা-টিয়াকে কেউ বল না। খালি ঠামু হঠাৎ গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে বসেই সরু গলায় চেঁচিয়ে বললেন, ওরে, আমাকে কেউ নামিয়ে দিচ্ছেনা কেন রে, দুষ্টু মেয়েদুটোকে আমি কি আদর করতে পাব না!
সোনা-টিয়া খালি বলে, ও মামণি, ও বাপি, কী করে জানলে আমরা এখানে পালিয়ে এসেছি? আম্মা চাচাতে লাগল, তা আর জানবে না? তোদের পিসে কি মিছিমিছি পুলিশসাহেব হয়েছে? তোমরা পালাবার পরেই তো তার লোকেরা খবর দিল। বলিহারি তোমাদের সাহস বাপু! যে-বনে সার্কাস পার্টির দুষ্টু অধিকারী দলবল নিয়ে গা ঢাকা দেয়, সেই বনে খালি হাতে ঢুকতে সাহস কর? ভাগ্যিস্ পিসে দেখতে পেয়েছিল, নইলে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে যেত, সেকথা কি একবার ভাবলে?
টিয়া চোখ মুছে শুধু বললে, মোটেই খালি হাতে নয়, পুঁটলিতে জিনিস ছিল। এতক্ষণে সোনা-টিয়ার খেয়াল হল বটতলায় অনেক পুলিশপেয়াদা। তারা অবিশ্যি ভজহরি আর বেহারিকে রান্নাবান্না আর খাবার জায়গা করতে সাহায্য করছে, তবু তাদের দেখে সার্কাসের লোকেরা ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় অন্ধকারের মধ্যে থেকে খাকি পোশাক পরা একজন লোক বেরিয়ে এল। তার দু-হাতে ও দুটো কী? ওই-না দুটো বড়ো বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল!!
সোনা-টিয়া হঠাৎ ও মাকু, ও মাকু–বলে তার গায়ের উপর লাফিয়ে পড়ল। এই তো তাদের আসল মাকু, আগের মাকু, আদরের মাকু, নিজেদের মাকু, সে যে সত্যি করে ওদের জন্য প্যা-প্যা পুতুল এনেছে। মাকু মাকু মাকু বলে তখন তাকে কী আদর। মামণি তো অবাক। মাকু কী রে? উনিই তো তোদের পিসেমশাই। উনিই তোদের খুঁজে দিয়েছেন, বাপির সঙ্গে গাছতলায় পিকনিকের ব্যবস্থা করেছেন।
সোনা-টিয়া অবাক, ওমা, মামণি, কী বলে, এটা না মালিকের জন্মদিনের ভোজ, পিকনিক আবার কোথায়?
মামণি বললেন, ওই একই কথা, ভোজ না আরও কিছু! এসে দেখি খাবার জিনিস মাটিতে গড়াগড়ি, কে-বা রাঁধে, কেবা খায়! তখন সবাই মিলে লেগে গেলাম। আজ বুঝি মালিকের জন্মদিন? কোথায় সে?
পিসেমশাই বললেন, হ্যাঁ, তাই তো! ও মালিক, তুমি কোথায় গেলে?
হাত জোড় করে, ভয়ে ভয়ে মালিক এসে পিসেমশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পিসেমশাই বললেন: কী, এত ভয় কীসের? শুনেছি ধার-দেনা সব শোধ করে দেবে, তাহলে আবার ভাবনা কীসের? আমার পুলিশরা তা হলে খেয়ে-দেয়েই বাড়ি যাক, কী বলে? তোমরা কাল থানায় গিয়ে টাকা জমা দিয়ে, ব্যবস্থা করে এসো, কেমন? আর সোনা-টিয়া, বোম্বাকে আদর করবে না?
আরে, ওই যে পিসির কোলে বোম্বা। পিসি বললেন, বোম্বা, ওই দ্যা দিদিরা। বোম্বা বলল, জিজিয়া। বলে খুশি হয়ে ওর হাতের সব কটা আঙুল একসঙ্গে মুখে পুরে দিল।
পিসেমশাই বললেন, উঃ, বড্ড খিদে পেয়েছে, এসো, আমরা খাই।
বোম্বা আরও খুশি হয়ে বলল, কাই।
তখন আর তাকে আদর না করে সোনা-টিয়া করে কী? এদিকে সার্কাসের লোকরা আহ্বাদে আটখানা, ভোজবাজির মতো তাদের সব ভাবনাচিন্তা দূর হয়ে গেছে। ঘড়িওলাকে পায় কে, মাকুকে যে কেউ কাঁদাতে পারবে এ তার আশার বাইরে ছিল। এখন যখন খুশি মাকুর চাদি খুলে জ্যামের টিনে জল ঢাললেই, হাপুস নয়নে কান্না! এত আনন্দ ভাবা যায় না। সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে বসে খেতে লাগল। মামণি বললেন, সারাদিন ওরা খেটেছে-খুটেছে, ওরা খেতে বসুক, আমরা পরিবেশন করি। বাজনাদাররা মিছিমিছি দেরি করে ফেলাতে, প্রথম দলে জায়গা পেল না। তাই তারা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে পি-ই-ই ভোপর-ভেঁপর ভোঁ ধরল। খাবারগুলো দ্বিগুণ মিষ্টি হয়ে উঠল।
বাপি স্বর্গের সুরুয়া খেয়ে মুগ্ধ। আহা এমনটি তো জন্মে খাইনি। কে রাঁধল?
মালিক লজ্জায় মাথা নীচু করে রইল, কে বেঁধেছে কারো বুঝতে বাকি রইল না। মামণি আর পিসি বললেন, ও মালিক, শিখিয়ে দাও, শিখিয়ে দাও।
টিয়া তো অবাক, ও তোমরা পারবে না, দাড়ি-গোঁফ দিয়ে করতে হয়।
সার্কাস পার্টির লোকদের কান খাড়া হয়ে উঠল। দাড়ি-গোঁফ দিয়ে করতে হয় আবার কী? ও মালিক, ব্যাপার কী?
সোনা তখন টিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, না, না, কিছু না, আজ সকালে মালিকের দাড়ি-গোঁফ হাঁড়িতে পড়েছিল কি না–।
সার্কাসের লোকেরা খুশি হয়ে বলল, তা দাড়ি-গোঁফই হোক আর পরচুলাই হোক, স্বর্গের সুরুয়ার মতো কেউ রাঁধুক দেখি! অবিশ্যি নোটোমাস্টারকে আর রাঁধতে দেওয়া হবে না; ও বলে দেবে, আমরা রাঁধব।