অমনি ঘুম ভেঙে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে মাকুও কেঁদে ভাসিয়ে দিল। দু-চোখ ভাসিয়ে দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে তো পড়ছেই; গালের নতুন লাগানো লাল রং ধুয়ে গড়াচ্ছে; শার্টের বুক, কোটের কলার ভিজে সপসপ করছে। যতক্ষণ না জ্যামের টিনের তলার ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে সব জল বেরিয়ে টিন খালি হয়ে গেল, ততক্ষণ মাকুর কান্না আর থামে না। একসঙ্গে এত বেশি কাঁদতে কাউকে বড়ো-একটা দেখা যায় না, সকলে সোনাকে সাধু সাধু বলতে লাগল। এত কাঁদতে পেরে মাকুও আনন্দের চোটে হেসে ফেলল। ফুর্তির চোটে মালিকের দাড়ি খামচে এক লাফে যেই মাকু উঠে দাঁড়াল, সঙ্গে সঙ্গে মালিকের দাড়িগোঁফও হ্যাঁচকা টানে খুলে গিয়ে, মাকুর হাতে ঝুলে থাকল।
একেবারে থ হয়ে এক সেকেন্ড উপস্থিত সকলে মালিকের চাচাছোলা ন্যাড়া মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল, তারপর, ওই ওই ওই আমাদের পালানো নোটো মাস্টার। হোটেলের মালিক সেজে এতকাল আমাদের মাঝখানেই লুকিয়ে ছিল গো। ও মাস্টার, বলি আমরা তোমার জন্যই হেদিয়ে মরছিলাম আর তুমি কি না ভোল বদলে এইখানেই ছিলে গো!
সবাই মিলে একসঙ্গে মালিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ তার হাত ধরে নাড়ে, কেউ পায়ের ধুলো মাথায় নেয় আর মেম তার দুই গালে দুটো চুমু খেল। যারা যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের সবার চোখে জল এসে গেল।
মালিক একসঙ্গে হাসতে হাসতে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ওরে, সত্যিই আমি তোদের সেই পালানো নোটো অধিকারী রে! জিনিস কিনে দাম না দিয়ে, তোদের সবাইকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিলাম আর তোদের পেছনেই পেয়াদা লাগল। তাই ভেবে দুঃখ রাখবার জায়গা পাই না! তবে সুখের বিষয়, আর কোনো ভয় নাই রে। পুলিশের ভয়ে ছদ্মবেশ ধরে, এতদিন হোটেল চালিয়ে যে টাকা জমিয়েছি আর আজ যা পেলাম, তাই দিয়ে সব ধার শোধ করে, জিনিস ছাড়িয়ে, নতুন তাঁবুর তলায় আবার নতুন করে সার্কাস খুলব রে। সবাই বললে সাধু! সাধু!
ঘড়িওলা ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তবে আরও পাঁচ হাজার টাকা হলেই হয়। তাহলে ঘড়ির কারখানায় গিয়ে, মাকুর যন্ত্রপাতির দাম চুকিয়ে ফেলি; আমারও আর পেয়াদার ভয় থাকে না, রোজ খেলা দেখিয়ে টাকার গাদা জমাই। তারপর একদিন ছুটি নিয়ে দুই ভাই মায়ের কাছে একবার গিয়ে, পেট ভরে চাপড়ঘণ্ট, মোচা-চিংড়ি আর দুধপুলি খেয়ে আসি।
এই বলে দুই ভাই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
সং বললে, কেঁদো না তোমরা, লটারি জিতলে, আমি টাকা দেব।
ঠিক সেই সময়ে আধময়লা বড়ো খাম হাতে গর্তে-পড়া সেই পেয়াদা এসে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে মাকুর হাত ধরে চাটাইয়ের পেছনে ঘড়িওলা অদৃশ্য। বাকিরা তেড়িয়া হয়ে লোকটাকে ঘেরাও করল, কাকে ধরতে এসেছ? মালিক কালই সব টাকা শোধ করে জিনিস ছাড়াবে। যাও এখান থেকে। লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়ল।
–সে কথা তো আমি কিছু জানি না। পোস্টমাস্টারমশাই বললেন, বনের মধ্যে যা, ফেলারাম, সংবাবুর চিঠি এসেছে; আমি পড়ে দেখেছি উনি লটারি জিতেছেন। টিকিটটা আপিসে জমা দিলেই পাঁচ হাজার টাকা পাবেন। এই নিন চিঠি।
একথা শোনবামাত্র সং অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল আর মালিক বুক চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল, হায় হায়, আমি যে আধখানা টিকিট হারিয়ে ফেলেছি। ওই দেখো, সঙের পকেটে শুধু আধখানা আছে। ওরে টিয়া, এত বললাম, তবু খুঁজে দিলি না তো।
সঙের পকেট থেকে আধখানা গোলাপি টিকিটের দিকে তাকিয়েই সোনা চমকে উঠল! টিয়ার হাত থেকে পুঁটলি, তার মধ্যে থেকে গোলাপি চাবিকাঠি বের করে, তার বাইরের গোলাপি মোড়ক খুলে ফেলল। ভিতর থেকে মামণির সিঁদুর পরবার রুপোর কাঠি বেরিয়ে পড়ল।
গোলাপি মোড়ক মালিকের হাতে দিয়ে সোনা বলল, এই নাও বাকি আধখানা। টিয়া, তুমি ভয়ানক দুষ্টু। খুঁজে পেয়ে টিকিট লুকিয়েছ! আর মামণির সিঁদুরের কাঠি না বলে নিয়েছ! ওও!
বকুনি খেয়ে টিয়া ভ্যা করে কেঁদে বলল, ওমা, ওটা কেন টিকিট হবে? টিকিটের ধারে আঁকড়াবাঁকড়া থাকে। তাই ওটাকে বটতলা থেকে তুলে মাকুর জন্য চাবিকাঠি বানিয়েছি।
ফিক করে সোনা হেসে ফেলল; ফিক করে ঘড়িওলা, জাদুকর, অধিকারী হেসে ফেলল; সংও মুচ্ছো ভেঙে ফিক করে হাসল, তাই দেখে টিয়া ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। আর উপস্থিত সকলে পেটে হাত দিয়ে হো-হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
হাসতে হাসতে যখন আর হাসা যায় না, তখন টিয়া ভ্যা করে কেঁদে বলল, আমাদের খাবার সময় হয়ে গেছে, বড্ড খিদে পেয়েছে, মামণি বাপি ঠামু আম্মাকে চাই!
সোনাও ম্যাও ধরল, আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে, আমিও ওদের চাই!
একী সর্বনাশ! সবারই যে খিদে পেয়েছে, অথচ বটতলার রান্নাবান্না আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে আছে, উনুন-টুনুন নিবে একাকার! তখুনি সবাই উঠে দৌড়, দৌড়, মালিকের কোলে টিয়া, জাদুকরের কোলে সোনা আর সবার আগে ঘড়িওলার হাত ধরে মাকু অন্ধকার বনবাদাড় ভেঙে পাঁই-পাঁই ছুটতে লাগল।
বনের মধ্যে তারার আলোয় সবাই মিলে ছুটতে ছুটতে যখন বটতলার কাছাকাছি পৌঁছেছে, অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, কোথায় অন্ধকার, বটতলা আলোয় আলো। কত লোক জমেছে, ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে, গনগন করে তিনটে উনুন জ্বলছে আর চারিদিকে যে সুগন্ধ ভুরভুর করছে, তার একটুখানি নাকে ঢুকেছে কি অমনি সব দুঃখ ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছে!