শেষটা মাকুর খেলা শেষ করে তাকে নিয়ে ঘড়িওলা যেই চলে যাচ্ছে, সবাই মিলে, বেজায় চাঁচাতে লাগল, মাকু-মাকু, মাকু! আরও খেলা দেখব। ঠিক সেই সময়ে দলবল নিয়ে জাদুকর ঢুকে পড়ে, চোখে চোঙা লাগিয়ে চিৎকার করে বলল, মাকুর খেলা এখনও শেষ হয়নি, একটু ধৈর্য ধরে চুপ করে বসুন, নইলে কল বিগড়ে যাবে।
অমনি সবাই চুপ।
সোনা-টিয়া ততক্ষণে তাদের পালা শেষ করে, দর্শকদের সকলের সামনে ঘাসের উপর পা মেলে বসে খেলা দেখছিল। সোনা ফিসফিস করে বলল, মাকুকে দেখে জাদুকরের বোধ হয় হিংসে হচ্ছে।
টিয়া জানতে চাইল, হিংসে কী দিদি?
সোনা রেগে গেল, তাও জানিস না? বোকা!
টিয়া বলল, মোটেই বোকা না। সব জানি। পিসির খোকাকে হিংসে, আম্মা বলেছে।
অনেকক্ষণ খেলা চলেছে, রাত হয়ে এসেছে, চারিদিকে অন্ধকার, কিন্তু ঘাসজমিতে আলোয় আলোময়। দূরের ছাউনিতে জানোয়াররা অনেক সুস্থ হয়ে উঠেছে, সারাদিনের পর আবার খেয়েছে, কুকুররা ডাকছে, মাঝে মাঝে ঘোড়াদের পা ঠোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমনকী জাদুকরের শাকরেদ এরই মধ্যে কখন গিয়ে ডবল ঘোড়া সাজিয়ে এনেছে। জাদুকর তাদের পিঠে মগডাল থেকে পরিদের রানিকে নামাল।
তার রূপ দেখে গাঁয়ের লোকের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল, তারা বার বার নমস্কার করতে লাগল। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের বলতে লাগল, ওরে গড় কর, গড় কর, আকাশ থেকে পরি এসেছে, আর আমাদের কোনো দুঃখুই থাকবে না।
তাদের দেখাদেখি সোনা-টিয়াও একবার ঠুক করে মাটিতে মাথা ঠুকে গড় করে নিল। ওদের কপালে এক টিপ করে ধুলো লেগে রইল, কেউ লক্ষই করল না। সবাই মাকুর গুণপনা দেখতে ব্যস্ত। পরিদের রানি নামতেই মাকু গিয়ে অধিকারীর কাছে হাজির। ঘড়িওলা তার কাছে গিয়ে কী যেন বলল, অমনি মাকু বাজনার সঙ্গে তাল রেখে নাচতে শুরু করে দিল। লোকেদের আনন্দ দেখে কে, তাদের বাহবাতে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়।
গাছের ডালপালার ভেতর থেকে ছেলেরা রাশি রাশি লাল হলুদ ফুল ফেলতে লাগল। পরিদের রানির খেলা শেষ হল, তাকে পিঠে নিয়েই দুই ঘোড়া বড়ো আলোর নীচে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। পরিদের রানিকে অধিকারী হাত ধরে নামাল। মাকুরও নাচ থেমেছে, ঘড়িওলা তাকে রানির সামনে দাঁড় করাল। সং বেতের ঝুড়িতে দু-গাছি মোটা গোড়ে-মালা আর বরের মাথার টোপর এনে দাঁড়াল।
জোরে জোরে বাজনা বাজতে লাগল, থোপা থোপা ফুল পড়তে লাগল। এইরকম মহা ধুমধামের সঙ্গে মাকুর আর পরিদের রানির বিয়ে হয়ে গেল। আনন্দের চোটে দর্শকদের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল, সোনা-টিয়াও নতুন জামার কোনা দিয়ে ঘনঘন চোখ মুছতে লাগল, তেমনি আবার হেসে হেসে গালে ব্যথা ধরে গেল।
খেলা শেষ হয়ে গেল,তবুও লোকেরা বাড়ি যেতে চায় না। ঘড়িওলা বড়ো আলোর নীচে দাঁড়িয়ে মুখে চোঙা লাগিয়ে, সবাইকে বলল, আজ আমাদের প্রিয় অধিকারীর জন্মদিন উপলক্ষে খেলা এইখানে শেষ হল। আপনারা সকলে সাধু সাধু বলুন।
তখন সে কী আকাশ-ফাটানো সাধুবাদ, চারদিকের জঙ্গল থেকে গমগম করে প্রতিধ্বনি উঠতে লাগল।
মালিককে ঠেলতে ঠেলতে সং বড়ো আলোর নীচে নিয়ে এল, লজ্জায় তার গাল পাকা আমের মতো লাল হয়ে উঠেছে, দাড়ি-গোঁফ এক বিঘত ঝুলে পড়েছে, সিন্ধুঘোটকের মতো দেখাচ্ছে। তাকে দেখেই যে যা পারে ছুঁড়ে দিতে লাগল ফুল, ফল, লাঠি, ছাতা, মাথায় দেবার টোকা, বাতাসার ঠোঙা, রুমাল, গামছা, পয়সা, সিকি। মালিকের গাল বেয়ে চোখের জল পড়তে লাগল, একটা কথাও বলতে পারল না।
শেষপর্যন্ত বুদ্ধি করে দড়ি টেনে দিয়ে জাদুকর বড়ো আলো নিবিয়ে দিল, অগত্যা লোকেরা বাড়ির পথ ধরল। তখন যে যেখানে ছিল, ক্লান্ত হয়ে ধপাধপ বসে পড়ল, ঘড়িওলা মাকুকেও টেনে বসাল। টিমটিম করে দু-ধারে দুটি লম্প জলছে, ছায়ার মতো সবাই পা ছড়িয়ে বসে, কারো মুখে কথা নেই, চারদিকে পয়সাকড়ি, জিনিসপত্র ছড়ানো। আবছায়াতে সঙের দল জিনিসপত্র পয়সা কুড়িয়ে মালিকের পাশে জমা করতে লাগল। এসব সে-ই পাবে। আজ তার জন্মদিন।
১১.
কারো মুখে কথা নেই, বসে আছে তো বসেই আছে, টিয়া একটু একটু পা নাচাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে ঘড়িওলা উঠে আবার বড়ো আলোটাকে জ্বেলে দিয়ে সোনাকে বলল, তাহলে এবার তোমার কথা রাখো। মাকুকে কাদার কল দাও। রোজ ওর বিয়ে দেওয়া হবে, কাদার কল নইলে চলবে কেন।
মাকুর মুখটা অমনি একটু খুশিখুশি মনে হল।
সোনা তার কাছে এসে ঘড়িওলাকে বলল, চাঁদি খোলো।
ঘড়িওলা মাকুর নাকের কল টিপে দিল। অমনি মস্ত একটা হাই তুলে মাকু ঘুমিয়ে কাদা। ঘড়িওলা মহাখুশি হয়ে ওর দুকান ধরে কষে প্যাঁচাল। অমনি সুন্দর লালচে কোঁকড়া চুলসুদ্ধ মাথার খুলি কট করে বাক্সের ঢাকনির মতো খুলে গেল। সবাই দেখল ভিতরের কলকজার মাঝে মাঝে ফাঁকা রয়েছে।
সোনা বললে, জল আনো।
ততক্ষণে যে যার জায়গা ছেড়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, টিয়া ঠেলেঠুলে একেবারে ঘড়িওলার কোলে চেপেছে।
হোটেলওলা নিজের জলের গেলাস দিল।
সোনা পুঁটলি খুলে ফুটো জ্যামের টিন, কেরোসিন তেল ঢালবার ফোদল আর বাপির কাজের ঘর থেকে-আনা রবারের নল বের করল।
তারপর কলকব্জার ফাঁকে সবচেয়ে উপরে জ্যামের টিন বসিয়ে, তার তলায় ফোঁদল দিয়ে তার মুখে বরাবর নল লাগিয়ে, নলের অন্য দিকটাকে মাকুর মুণ্ডুর ভিতরে দুই চোখের মাঝখানে খুঁজে দিল। তারপর গেলাসের জলটুকু টিনে ঢেলে, পট করে খুলির ঢাকনি বন্ধ করেই, মাকুর নাকের টিপকল টিপে দিল।