সবার মুখেই হাসি ফুটল; খালি সোনা-টিয়ার মন খারাপ, চাবি ফুরিয়ে অবধি মাকু তাদের ভুলে গেছে। ওদের মুখ দেখে সঙের বড়ো কষ্ট হল, কানে কানে বলল, মেলা টিকিট বিক্রি হয়েছে, মালিক তোমাদের জন্যে দুটো বড়ো বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কিনবে বলেছে, এখন চলো দিকিনি!
কী সুন্দর করে মেমসাহেব ওদের সাজিয়ে দিল, সাদা করে সারা মুখে পাউডার মেখে মাথায় রেশমি ফিতে বেঁধে, গলায় মালা দিয়ে, সেন্ট মাখানো রুমাল নিয়ে, মাকুর কথা তখনকার মতো ওরা ভুলে গেছে।
এদিকে ঘাসজমিতে লোক ধরে না; কাতারে কাতারে সবাই বসে গেছে। দেওয়াল নেই, চেয়ার নেই, গ্যালারি নেই, টিকিট দেখবার লোকও নেই, যে আসছে সেই যেখানে পারে বসে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় চারদিক গমগম করছে। ঘাসজমির মাঝখানে পুরোনো শিরীষ গাছ অনেক উঁচুতে ডালপালা মেলে, প্রায় তাবুই বানিয়ে রেখেছে, তারই নীচে সার্কাস হবে। গুঁড়ির দু-পাশে খানিকটা জায়গা চাটাই দিয়ে আড়াল করা, তার পিছনে সার্কাস পার্টির লোকেরা সেজেগুঁজে অপেক্ষা করছে।
এমনি সময় রোল উঠল, সবই হল, কিন্তু রিং-মাস্টার কে হবে? সবাই যদি খেলায় নামে, খেলা দেখাবেটা কে তাহলে? লিকলিকে বেত হাতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে কে চাঁচাবে?সং বলল, মালিক, তুমিই হও। রোজ আমাদের মশকো করিয়েছ, তোমার মতো ওস্তাদ কোথায় পাব বলো?
এদিকে সময় হয় হয়, কিন্তু হোটেলওলা রাজি হতে চায় না। ঘড়িওলা অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষটা রেগে গিয়ে মালিককে দেখিয়ে মাকুকে বলল, ওই ইঁদুর, ধরো।
মাকু অমনি এক লাফে মালিককে এমনি জাপটে ধরল যে সে বেচারা প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল, হব, হব, রিং-মাস্টার হব, আরে আমি কি তাই বলেছি নাকি, লজ্জাও করবেনা নাকি! ওরে ব্যাটা ছেড়ে দে, কেঁদে বাঁচি!
সবাই ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগল, ওরে মাকু, ছেড়ে দে রে।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। শেষ অবধি ঘড়িওলা মাকুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ছাগল ছাড়ো। মাকু অমনি হাত নামিয়ে নিল। হোটেলওলা নিজের হাত-পা টিপেটুপে দেখে বলল, উফ্, আরেকটু হলেই চিড়ে-চ্যাপটা হতাম! তোর মাকু তো সাংঘাতিক লোক রে?
অনেকেই ফিকফিক করে হাসতে লাগল। ঘড়িওলা বুক ফুলিয়ে বলল, হ্যাঁ, ও আমার ছাড়া কারো কথা শোনে না। মাঝে মাঝে আমারও শোনে না!
শুনে সোনা অবাক, মাকু যখন হোটেলে কাজ করত তখন তো যে যা বলত তাই শুনত। নতুন চাবি দেবার পর হয়তো বদলে গেছে! চাবিটাই হয়তো খারাপ, টিয়া কোথায় পেল কে জানে। মামণির দেরাজে মোটেই ওইরকম গোলাপি কাঠি ছিল না।
তারপরেই খেলা আরম্ভ হয়ে গেল। মাকুকে চাটাইয়ের আড়ালে টুলের উপর ঘড়িওলা বসিয়ে রেখেছে, ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ও সব দেখতে পাচ্ছে। সোনা-টিয়াও তার পিছনে দাঁড়াল। সঙের কাণ্ড দেখে ওরা হেসে বাঁচে না। একগালে চুন আর একগালে কালি মেখে, গাধার টুপি মাথায় দিয়ে, একটার পর একটা উলটো দিক দিয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে আর কী সব বলছে, শুনে গাঁয়ের লোকেরা বেজায় হাসছে। দড়াবাজির ছেলেরা যখন উপরের দোলনা থেকে লাফিয়ে নীচে নামছিল, সং তখন নীচে থেকে লাফিয়ে উপরের দোলনায় উঠতে চেষ্টা করছিল।
গাঁয়ের লোকদের হাততালিতে কান ঝালাপালা!
চাটাইয়ের বেড়ার মাঝখানে ঢুকবার পথ, তাতে মস্ত নীল মখমলের ছেঁড়া পর্দা ঝুলছে; এক পাশে মাচা বেঁধে বাজনাদাররা বসেছে; গাছের ডাল থেকে একটা প্রকাণ্ড বড়ো ডে-লাইট বাতি ঝুলছে, তা ছাড়া ছোটো দুটোও আছে।
দড়ির বাজি শেষ হল।
এবার সোনা-টিয়ার পালা; সবাই মিলে নীল পর্দার তলা দিয়ে ঠেলেঠুলে ওদের দর্শকদের সামনে বের করে দিল। সং অমনি সেলাম ঠুকে একপাশে গিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াল। সবাই হাসতে লাগল।
এত দর্শক দেখে ভয়ের চোটে সোনার হাত-পা ঠান্ডা, গলা শুকিয়ে কাঠকয়লা! টিয়ার এতটুকু ভয় নেই, সোনার হাত ধরে টেনে মাঝখানের বড়ো আলোর নীচে দাঁড়িয়ে একটা নমস্কার করেই হাত মেলে গান জুড়ে দিল, ফুল কলি আসে অলি গুন্ গুন্ গুঞ্জনে! অমনি সোনার ভয় দূর হয়ে গেল, আলোর নীচে দুই বোনে নাচতে গাইতে লাগল আর গাছের উপর থেকে দড়াবাজির ছেলেরা লুকিয়ে বসে, ছোটো ছোটো সাদা ফুলের বৃষ্টি করতে লাগল। গাঁয়ের লোকদের মুখে আর হাসি ধরে না।
গান শেষ হলে সং পর পর পাঁচটা ডিগবাজি খেয়ে, নীচে থেকে এক লাফে সত্যি সত্যি বড়ো দোলনায় উঠে পড়ে, দুটো বড়ো বড়ো করতাল দিয়ে হাততালি দিতে লাগল।
দর্শকরাও তাই দেখে দ্বিগুণ জোরে হাততালি দিল। সোনা-টিয়া লজ্জা পেয়ে দু-হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইল।
হোটেলওলা আজ রিং-মাস্টার হয়েছে, সে দু-জনার পিঠে দুই-হাত রেখে তাদের কত প্রশংসা করল। তারপর আরও দু-একটা খেলার পর ঘড়িওলা মাকুকে নিয়ে আলোর নীচে দাঁড়াল। সোনা-টিয়া অবাক হয়ে দেখল মাকুর হাঁটা পর্যন্ত বদলে গেছে। মালিক তখন সেই পুরোনো গোলাপি হ্যাঁন্ডবিলটা বের করে পড়তে লাগল আর দর্শকরা অমনি অবাক হয়ে গেল যে কারো মুখে টু শব্দটি নেই।
এদিকে সঙের দলের ছেলেরা গাছতলায় টপাটপ কত জিনিস যে এনে ফেলল তার ঠিক নেই। ঘড়িওলা মাকুকে যা বলে, সেও তাই করতে লাগল, সেও এক দেখবার জিনিস। নাচল, গাইল, কাঠের বাক্সে পেরেক ঠুকল, মোড়লের সাইকেল চেপে গাছতলাতেই পাঁই-পাঁই চক্কর দিল, পড়া বলল, অঙ্ক কষল, মেমের সেলাইক চালাল, ভাঙা টাইপরাইটার দিয়ে ইংরিজিতে চিঠি লিখল, ঘড়িওলার সঙ্গে কুস্তি করল। দেখে দেখে সবার থুতনি ঝুলে পড়ল। অথচ চাকর সেজে যখন মাকু লুকিয়েছিল, এর চেয়েও কত বেশি কাজ করেছে, কলের পুতুল বলে চেনা পর্যন্ত যায়নি, তবু কেউ হাততালি দেয়নি। এখন মানুষের মতো কাজ করে বটে, কিন্তু খটখট করে চলে, ক্যান ক্যান করে কথা বলে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে মজার মুখ করে না।