কে কার কথা শোনে, সোনা-টিয়া, খিড়কি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে, বাইরে থেকে ছিটকিনি টেনে আম্মার বেরুনোর পথ বন্ধ করেই এক ছুট।
রাস্তাটা কিন্তু বড্ড ফাঁকা, সরু গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি কেউ নেই, দুপুরের রোদে পায়ের কাছে নিজেদের ছায়াগুলোকে জড়ো করে এনে গাছপালা ঝিমঝিম করছে।
সোনা দেখল টিয়া যেন পেছিয়ে পড়ছে। চুপ, পেছন দিকে তাকাতে হয় না।
টিয়ার হাত ধরে সোনা লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগল।
–কেন দেখতে হয় না?
–তাহলে–তাহলে প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল পায় না। টিয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, পিসির খোকার নতুন প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল এসেছে, আমাদের নেই! সোনা তার চোখ মুছিয়ে, গালে চুমু খেয়ে বলল, কালিয়ার বনে আমরা দুটো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কিনব, কেমন?
গলির পর বড় রাস্তা, তারপর গির্জে, তারপর গোরস্থান। গোরস্থানের পর শুনশুনির মাঠ, আগে সেখানে ডাকাত পড়ত, তারপরেই দূর থেকে দেখা যায় ঘন নীল কালিয়ার বন। গোরস্থানের পাশ দিয়ে হনহনিয়ে যেতে হয়। তোতার আয়া বলেছে বিশুদাকে, কারা নাকি সুরে ডেকেছিল, সে ফিরেও তাকায়নি বলে বড়ো বাঁচা বেঁচেছিল!
গোরস্থানের ফটকের কাছে ঝোলাঝালা কোটপেণ্টলুন পরা একটা অচেনা লোক, পিঠে একটা ঝুলি। সোনা-টিয়া পাশ কাটাতে যাবে, লোকটা পথ আগলে বলল, আমি ঘড়িওয়ালা, সারাদিন কিছু খাইনি, পুটলিতে কী খাবার আছে, প্লিজ দেবে?
সোনা-টিয়ার বড়ো দুঃখ হল; সোনা তাকে একমুঠো মুড়ি লজেঞ্জুস আর টিয়া একটা গোলাপি চিনিলাগা বিস্কুট দিল। চেটেপুটে তাই খেয়ে, ঝোলা কাঁধে লোকটা ওদের সঙ্গে চলল। সোনা বলল, তুমি ছেলেধরা নও তো? তাহলে আমার বাপি দোনলা বন্দুক দিয়ে তোমাকে শেষ করবে কিন্তু।
সে বলল, আরে ছোঃ, ছোঃ, আমি ঘড়িওলা, ছেলে ধরব কী, আজকাল ছেলে দেখলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনতে পারি কি?
টিয়া বলল, আমরা কালিয়ার বনে যাচ্ছি, সেখানে প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কিনব!
সোনা বলল, পিসির খোকা আসছে বলে খেলনা হচ্ছে, মিষ্টি তৈরি হচ্ছে, আমাদের আর কেউ চায় না।
–তা কালিয়ার বনে যেতে ভয় করছে না?
–না, আমরা যে স্কুলে ভরতি হয়েছি, ভয় পাই না।
–তাহলে আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে? কালিয়ার বনে আমার মাকু আছে কি না একটু খোঁজ নেবে কি?
–কেন, মাকু দিয়ে কী করবে?
–ওমা, তার ওপর যে আমার বড়ো মায়া। তার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে যে আমার গেটো ধরে গেছে। সোনা বলল, মায়া তো পালালে কেন? লোকটা অবাক হয়ে গেল।
–পালাচ্ছি প্রাণের ভয়ে। কিন্তু মায়া হবে না তো কী! সতেরো বছর ধরে তাকে তৈরি করেছি যে। খেতে খেতে ভেবেছি মাকুর পায়ে ক-টা গাঁট দেব, আর খাওয়া হয়নি। শুয়ে শুয়ে ভেবেছি মাকুর মাথায় পাকানো তারটি কোথায় বসাব, চকমকি পাথরটি কোথায় রাখব, আর ঘুম হয়নি।
সোনা বলল, ও ঘড়িওলা, মাকু কি তবে একটা ঘড়ি? ঘড়ির ভয়ে কেউ পালায়? ঘড়ি হাঁটতে পারে নাকি? লোকটা তাই শুনে হাঁ। ওমা বলে কী, ঘড়ি চলে না! অচল ঘড়ি চালু করাই যে আমার কাজ। তাছাড়া–। এই বলে ঘড়িওলা দুঃখ দুঃখ মুখ করে চুপ করল।
টিয়া ওর হাত ধরে বলল, বলো ঘড়িওলা, মাকুর কথা বলো। সে কীরকম ঘড়ি, তাই বলো।
ঘড়ি সে নয়, যদিও ঘড়ির কল দিয়ে ঠাসা।
–সে কি তবে কলের পুতুল? টিন দিয়ে তৈরি?
লোকটা রেগে গেল। দেখো, মাকু কথা বলে, গান গায়, নাচে, অঙ্ক কষে, হাতুড়ি পেটে, দড়ির জট খোলে, পেরেক ঠোকে, ইস্ত্রি চালায়, রান্না করে, কাপড় কাঁচে, সেলাই কল চালায়
–তবে কি চাকর?
ঘড়িওলা কাষ্ঠ হেসে বলল, চাকর নয়, বরং মুনিব হতে পারে। সব করতে পারে, শুধু বেশি হাসতে পারেনা আর কাঁদতে পারেনা। তাই আমার উপর রাগ, দিন-রাত খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে, আমাকে ধরলেই হাসার কল, কাঁদার কল বসিয়ে নেবে। তাহলেই সে একটা আস্ত মানুষ হয়ে যাবে, রাজার মেয়ে বিয়ে করবে।
তাই শুনে সোনা-টিয়া এমনি অবাক হয়ে গেল যে হাত থেকে পুঁটলি দুটো ধুম করে মাটিতে পড়ে গেল। ঘড়িওলা চমকে গিয়ে বলল, পুঁটলিতে ধুম করে কী?
সোনা বলল, ও কিছুনা, জ্যামের খালি টিন, কেরোসিনের বোতলের ফেঁদল আর রবারেনল। নিয়ে যাচ্ছি বনে, যদি কাজে লাগে। কোথায় পাবে রাজার মেয়ে?
ঘড়িওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, বড়ো সাধ ছিল, নোটো মাস্টারের সার্কাস পার্টিতে মাকুতে-আমাতে খেলা দেখাব, আর আমাদের দুঃখ থাকবে না। তাই খেলা দেখতে নিয়ে গেছিলাম, সেই আমার কাল হল।
–কেন কাল হল?
– সার্কাসের জাদুকর বাঁশি বাজিয়ে জাদুর রাজকন্যে দেখাল, মাকু বলে ওই রাজকন্যে আমি বিয়ে করব। জাদুকরের কী হাসি, কলের তৈরি খেলনা, কাতুকুতু দিলে হাসে না, দুঃখ হলে কাঁদে না, সে বিয়ে করবে আমার ভেল্কির রাজকন্যে, পরিদের রানিকে! যা ভাগ! সেই ইস্তক মাকু আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, অথচ ওকে তৈরি করতেই আমার সব বিদ্যে ফুরিয়ে গেছে, হাসি-কান্না আমার কম্ম নয়।
সোনা বললে, কতদিন পালিয়ে বেড়াবে? বাড়ি যাবে না? তোমার মা নেই?
ঘড়িওলা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।
–আছে গো, আছে, সব আছে; বড়ো ভালো সরুচাকলি বানায় আমার মা, একবার খেলে আর ভোলা যায় না। কবে যে তাকে আবার দেখতে পাব!
টিয়া বললে, দুষ্টু মাকু থাকগে পড়ে, তুমি মার কাছে ফিরে যাও। এই বলে পুটলির কোনা দিয়ে টিয়া চোখ মুছল।