টিয়া ঝুলতে ঝুলতে বলল, হ্যাঁ, আমরা খুব দৌড়োতে পারি; মাকু যদি মরে যায়?
ঘড়িওলা হাসল, কলের পুতুল আবার মরে নাকি? মরলেও চাবি দিলেই আবার জিন্দা হবে। ও টিয়া, সত্যি করে চাবি দিতে পারবে তো?
টিয়া হঠাৎ হাত ছেড়ে নেমে পড়ে দৌড়াতে লাগল, দেব, দেব, ঠিক দেব?
ঘাসজমির যতই কাছে আসা যায় চাপা গোলমাল শোনা যায়; বাদ্যকররা ট্যাম কুড় কুড় করে বাজনা অভ্যাস করছে, কিন্তু কারো মনে ফুর্তি নেই। কুকুরদের ছাউনির বাইরে তেলো হাঁড়ির মত মুখ করে সবাই দাঁড়িয়ে। বড়ো মেম চোখে রুমাল দিয়ে গাছের গুঁড়ির উপরে সাদা জুতো মোজা পায়ে দিয়ে বসে আছে; চোখের মুখের রং লেগে রুমালে লাল-কালো ছোপ ধরেছে।
ছাউনির তলায় আলো কম, তাই বড়ো ডে-লাইট বাতি জ্বালা হয়েছে, তারই নীচে ময়লা শতরঞ্চির উপর হাত-পা এলিয়ে মাকু পড়ে আছে। তার দিকে তাকানো যায় না। তাকে চেনা যায় না। এই কি সেই সুন্দর মাকু? একটু আগেও কত কথা বলেছে, ধুপধাপ করে জঙ্গলের মধ্যে কেমন হেঁটেছে আর এখন ময়লা শতরঞ্চিতে হাত-পা টান করে, চক্ষু মুদে পড়ে আছে! চেহারাটাই বদলে। গেছে, কী শক্ত শক্ত কাঠ কাঠ হাত-পা। এরই মধ্যে মাকুর এ কী হাল হল, দেখলেই কান্না পায়। তার উপর নাকে-মুখে-চোখে রং দেবার লোকেরা তুলি বুলিয়েছে, কী দিয়ে তাকে চেনা যাবে?
নাকের কালো তিলটা জ্বলজ্বল করছে, আরও বড়ো দেখাচ্ছে। ঘড়িওলা হাঁটু গেড়ে পাশে বসে পড়ে বললে, ওই তিলের নীচে টেপা কল আছে; আগে চাবি দিয়ে, তারপর কল টিপলে, তবে মাকু চলবে ফিরবে, কথা কইবে, কাজ করবে। কই টিয়া দিদি, তোমার চাবি দেবার যন্ত্রখানি এবার বের করো দিকিনি! আমার মাকুর দিকে তাকালে যে চোখে জল আসে।
সোনার বুক ঢিপঢিপ করে; টিয়ার কাছে যদি চাবিনা থাকে? চাবি দিয়ে কল টিপলেও যদি মাকু উঠে না বসে, চোখ না খোলে? পুটলি হাতে করে তড়বড়িয়ে টিয়া গিয়ে মাকুর মাথার কাছে উবু হয়ে বসল।
–কই, চাবির ছ্যাঁদা কই?
ঘড়িওলা, সং, জাদুকর, আরও দু-জন ষণ্ডা লোক, মিলে হেঁইও হেঁইও করে মাকুকে উপুড় করে দিল। মাটির উপর ধড়াম করে শব্দ হল, কী ভারী রে বাবা!নতুন কোট শার্ট আঁটো করে পরা; যত্ন করে ঘড়িওলা গলার বোতাম খুলে, জামাগুলো ঢিলে করে, ঘাড়টাকে খালি করে দিল।
ঘাড়ের নীচে, দুই ডানির মাঝখানে, ছোটো একটি গোল ছাদা। টিয়া পুঁটলি খুলে, তার কড়ে আঙুলের চেয়েও সরু ছোট্ট গোল একটা গোলাপি কাঠি বের করে, তার মাথাটাকে ছাদায় ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে পাক দিতে লাগল।
ঘড়িওলা মাথা বাগিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, দাও দাও, আমাকে দাও, তুমি পারবে না।
টিয়া কনুইয়ের গুতো দিয়ে ঘড়িওলাকে সরিয়ে চাবি ঘোরাতে লাগল, বলল, আমি দু-শো অবধি গুণতে পারি।
ঘড়িওলা খুশি হয়ে গেল। এমন কল আর কেউ করুক তো দেখি; চলে ফেরে, কথা বলে, সাইকেল চালায়, পেরেক ঠোকে; অথচ ছোটো মেয়ের হাতেও মাখনের মতো চলে। টিয়া মুখ তুলে বলল, আমরা বড়ো হয়েছি, স্কুলে ভরতি হয়েছি, আগের মতো কদিনা। হোটেলওলা শুনে অবাক, এই বুঝি কম কাদা, তাহলে আগে না জানি কী ছিল!
যখন চাবি আর ঘোরেনা, টিয়া ঘড়িওলার দিকে চাইল; আঙুলের আগা দিয়ে চেপে-চুপে দেখল, সত্যই পুরো চাবি দেওয়া হয়েছে। সোনা হাত বাড়িয়ে টুক করে চাবিটাকে ছাদা থেকে বের করে নিয়ে ভালো করে দেখতে যাবে, এমন সময় টিয়া ছোঁ মেরে সেটাকে নিয়ে আবার পুঁটলির মধ্যে গুঁজে রাখল।
এবার মাকুকে চিত করা হল। চেহারা এখনও যেমনকে তেমন, দেখে চেনা যায় না, বেচারা মাকু। সোনা আস্তে আস্তে ওর কালো বুট-পরা পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল; কী কেঠো-পা! সোনার কান্না আসছিল। টিয়ার সবটাতেই সর্দারি, ঘড়িওলা কিছু বলবার আগেই পুট করেনাকের টিপকলটা টিপে দিল।
অমনি মাকুর মাথার মধ্যে থেকে, বেড়ালরা খুশি হয়ে গলা থেকে যে-রকম শব্দ বের করে, সেই রকম খ-র-র-খ-র-র-র শব্দ হতে লাগল। চোখের পাতা কেঁপে উঠল, হাত-পা নড়ল, মাকু উঠে বসল। টিয়া আহ্লাদে আটখানা হয়ে, ও মাকু বলে মাকুকে জড়িয়ে ধরল। মাকু ওকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। টিয়া মাটিতে পড়ল, মাথা ঠুকে গেল, কাঁদবে বলে হাঁ করেছে, এমনি সময় ঘড়িওলা গম্ভীর গলায় ডাকল, ছেলে!
মাকু বললে, বাপ!
নাম বলো।
–মাকু।
–দুই আর দুই-এ কত হয়?
–চার।
চার থেকে তিন নিলে কত থাকে?
–এক।
–তা হলে একটু নাচো গাও, মাকু।
মাকু অমনি এক হাত কোমরে দিয়ে এক হাত আকাশে উড়িয়ে, বিলিতি কায়দায় গেয়ে উঠল, ইয়াঙ্কি ডুডল ওয়েন্ট টু টাউন রাইডিং-অন-এ পোনি! এখন টিয়ার কাদা হল না, হাঁ করে দু-জনে তাকিয়ে রইল। ঘড়িওলা বললে, খুব ভালো, মাকু। এখন এই টুলে বসে বিশ্রাম করো, বেশি চাবি খরচ করে দরকার নেই। খেলা শুরু হলে আমি তোমাকে ডেকে নিয়ে যাব। দেখো জাদুকর কেমন পরিদের রানিকে নামাবে।
জাদুকরও এগিয়ে এসে বলল, রোজ তোমার সঙ্গে মহা ঘটা করে পরিদের রানির বিয়ে দেব, হাততালিতে আকাশ ভেঙে পড়বে। বিয়ের জিনিসপত্র সব রেডি। এই বলে শূন্য থেকে একটা সানাই নামিয়ে এনে জাদুকর পোঁ ধরল।
মেমের চোখের জল শুকিয়ে মুখে হাসি ফুটেছে, গালেকপালে লাল-কালো রং লেগেছে। সে সবাইকে ডেকে বলল, আর দেরি নয়, বেড়ার বাইরে লোকজন আসতে আরম্ভ করেছে, মাকু রেডি, আমি মুখটা মেরামত করলেই রেডি, তোমরাও সেজেগুঁজে নাও। লক্ষ্মী মেয়েরা, এসো, তোমাদের নতুন জামা পরিয়ে, মালা পরিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, মাথার চুলে বো বেঁধে, রুমালে সেন্ট ঢেলে দিই, তোমরাও যে নাচবে গাইবে।