জাদুকর তাই দেখে রেগে গেল। ছিঃ কানে কানে কথা বলা ভারি অসভ্যতা, তাও জান না! সোনা লজ্জা পেল, আর বলব না, জাদুকর।
খচমচ করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে হোটেলওলা উপরে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মাকুকে পাওয়া গেছে শুনেছ?
সোনা-টিয়া জানতে চাইল, কে পেল, কোথায় পেল। মালিকের মুখে একটু হাসি দেখা দিল, কন, যার জিনিস সেই পেল। বাঁশ বনেতে খরগোশ ধরবার ফাঁদে আটকে বাছাধন চাবি ফুরিয়ে পড়েছিলেন। কল ছাড়িয়ে কাঁধে করে তাকে কুকুরদের ঘরে রাখা হয়েছে। চাবিটা পাওয়া যাচ্ছে, এই হয়েছে মুশকিল। যাও তো জাদুকর, জাদুবলে কিছু হয় কি না একবার দেখো দিকিনি।
সে কিছুতেই যেতে চায় না, বলে কিনা জাদু দিয়ে কেউ কখনো চাবির কল ঘুরিয়েছে বলে কেউ শুনেছ? তাহলে তো ভাবনাই ছিল না, জাদুকরদের আর বটতলার হোটেলে আধপেটা খেয়ে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হত না।
শেষপর্যন্ত কোনোমতে ঠেলেঠুলে তাকে রওনা করে দিয়ে, হাত-পা এলিয়ে হোটেলওলা শুয়ে পড়ল। ব্যাপার বড়ো ঘোরালো, দিদিরা, শেষ অবধি সব করেও না আসল কাজটি পণ্ড হয়।
সোনা বলল, কিন্তু চাবি ফুরুল কেন? ঘড়িওলানা বলেছিল, পনেরো দিন চলবে?
–সে আর বলে লাভ নেই। ফাঁদে পড়ে বেটা নিশ্চয়ই পেল্লায় হাত-পা ছুঁড়ে, চেঁচিয়ে-মেচিয়ে পনেরো দিনের চাবি এক দিনেই শেষ করেছে।
টিয়া ঢোক গিলে বলল, ঘড়িওলা ওকে স্কুড্রাইভার দিয়ে খুলে ফেলবে না তো?
মালিক তো হাঁ, পাগল নাকি! ও হল গিয়ে রাগের কথা। মাকু একটি সোনার খনি। ও খনি সার্কাস পার্টিকে বড়োলোক করে দিতে পারে। মুশকিল হল যে জানাজানি হলেই পেয়াদা এসে ঘড়িওলাকে ধরবে, মাকুর কলকজা যে ও না বলে নিয়েছিল। টিয়া ফিক করে হেসে ফেলল, পেয়াদা ওকে ধরবে কী করে? তাকে তো আমরা বাঘের ফাঁদে ফেলে দিয়েছি, সে ভীষণ চাঁচাচ্ছে?
তারপর হোটেলওলাকে পেয়াদার কথা বলতে হল, তারই মধ্যে মুখ কালো করে ঘড়িওলা এল। ও দাদা, চাবির কী করা যায়? সঙেরা রং মাখিয়ে ওর চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছে, মেম নতুন কাপড় চোপড় পরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ও যে নড়েও না চড়েও না, মড়ার মতো পড়েই আছে।
তাই শুনে সোনা-টিয়া একসঙ্গে কেঁদে উঠল, ও বাপি ও মামণি, মাকু মরে গেছে। ঘড়িওলা রেগে টং। ও আবার কী কথা! মরে যাবে কেন?কলের পুতুল, আবার মরে নাকি? এমন মজবুত জিনিস দিয়ে গড়েছি, মাকু সহজে ভাঙবেও না, চাবি দিলেই কেমন জ্যান্ত হয়ে উঠবে দেখো। আছে তোমাদের পুঁটলিতে ছোটো কানখুশকি বা ওই ধরনের কিছু? আমি তো ভয়েতেই সব ছেড়েছুঁড়ে এসেছি।
সোনা বললে, টিয়া, মামণির কঁচি এনেছ, কনখুশকিটা আননি?
টিয়া মাথা নাড়ল। সোনার কী রাগ!
–ভারি দুষ্টু মেয়ে টিয়া, মামণি কত বারণ করে তবুনখ কাটার ভালো কঁচি এনেছে, যদি আগা ভোঁতা হয়ে যায়? আর কঁচিই যদি আনলে তো কানখুশকিটা আনতে পারলে না, ও-ও-ও!!
বকুনি খেয়ে টিয়া আবার একটু কাদল তারপর চোখ মুছে বলল, ছিল না ওখানে, খুঁজে পাইনি। আমি কানখুশকি বানিয়েছি, তাই দিয়ে চাবি ঘোরাব। চলো। ঘড়িওলা আনন্দে লাফিয়ে উঠে দু-জনার হাত ধরে টানতে টানতে গাছঘরের কেঠো সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই, হোটেলওলা বলল, বাঃ সাজা-গোজার জিনিস নেবেনা?নাচবে-গাইবেনা। বেলা গেছে, এখানে আর ফেরা হবে না, ঘাসজমিতেই সাজতে হবে, গোমেস মেমসাহেব কেমন তোমাদের সাজিয়ে দেবে দেখো। ওর হাতে জাদু আছে, পরিদের রানিকে দেখনি, কে বলবে যে একটা–
মালিক বললে, এক যদি কোনোরকমে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়। সঙের লটারি টিকিটেরও আধখানা গেছে হারিয়ে, নইলে–একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হোটেলওলা থামল। সোনা-টিয়ার খুব কষ্ট হতে লাগল, ওরা হোটেলওলার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল!
তারপর ঘড়িওলার তাড়ার চোটে সবাই মিলে ঘাসজমির দিকে রওনা দিল। কড়াইভরা ঘন দুধের পায়েস, কাঁচা হরিণের মাংস, ভালো ভালো সুগন্ধি চাল, কিশমিশ, বাদাম, মশলা, হাঁড়িভরা স্বর্গের সুরুয়া বটতলাতে ঢাকা চাপা হয়ে পড়ে রইল, রাঁধাবাড়ার কথা কারো মনেও হল না।
১০.
পশ্চিম দিকে সূর্য হেলে পড়েছে, গাছের ছায়া লম্বা হয়েছে, এমন সময় বনের মধ্য দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়, ঘড়িওলা খেপল নাকি? ঘড়িওলা টিয়ার হাত আর হোটেলওলা অন্য হাত ধরে এমনি ছুট দিল যে মাটি থেকে টিয়ার পা দুটো এক হাত শূন্যে ঝুলতে লাগল, চ্যাংদোলা হয়ে টিয়া চলল; সোনাও পাইপাঁই পা চালাতে লাগল।
ঝুলতে ঝুলতে টিয়া হাসি হাসি মুখ করে বলতে লাগল, কোনো ভয় নেই, আমি মাকুকে চাবি লাগিয়ে দেব, আমি মাকুর জন্য চাবি বানিয়েছি, পুঁটলিতে আছে।
ঘড়িওলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কী দিয়ে বানিয়েছ শুনি?
–কেন, জিনিস দিয়ে। দিদির পুঁটলিতেও জিনিস আছে, দিদি তাই দিয়ে কাদার কল বানাবে, না দিদি?
সোনা বললে, হ্যাঁ। তাহলে মাকু কঁদবে; জাদুকর রোজ পরিদের রানির সঙ্গে ওর বিয়ে দেবে বলেছে, তাই দেখে দেশের লোক ধন্য ধন্য করবে, জাদুকর বলেছে।
–উঃ!
–কী হল? পায়ে কী ফুটল?
হোটেলওলা থমকে দাঁড়িয়ে ঘড়িওলাকে বলল, তোর কোনো আক্কেল নেই, অত যে ছুটছি, ওরা কত ছোটো ভুলে যাচ্ছিস কেন?
সোনা বললে, না, না, না, আমরা বড়ো হয়েছি, স্কুলে ভরতি হয়েছি, আমরা দৌড়োতে পারি; চলো তাড়াতাড়ি চলো, নইলে মাকু যদি সত্যি মরে যায়!