গান শুনেই ঝোঁপের মধ্যে থেকে সরসর করে বেরিয়ে এল এত বড়ো ডোরাকাটা সাপ, কুণ্ডুলি পাকিয়ে ফণা তুলে, আস্তে আস্তে সে দুলতে আরম্ভ করল। দেখে টিয়ার চোখ ছানাবড়া! সোনা বলল, আম্মা বলেছে, সাপেরা পাশ দিকে ছুটতে পারে না, মনে নেই? এই বলে টিয়ার হাতে পাশ থেকে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে, দু-জনে দৌড় দৌড়! ওই দু-দিনে কত যে দৌড়োল দু-জনে তার। ঠিক নেই!
.
বটতলাতে কেউ নেই। উনুনের আঁচ পড়ে এসেছে, উনুনে চাপানো দুধের কড়ার দুধ ফুটে ফুটে ঘন হয়ে এসেছে, সোনা তাতে মিছরির ঠোঙা, কিশমিশের কৌটো খালি করে দিল। তারপর কড়াইটাকে ঢাকা দিয়ে, দু-জনে দু-মুঠো খেজুর খেয়ে, জল খেয়ে ছোটো নদীতে হাত-পা মুখ ধুয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে বটগাছে ঝোলানো ঘরে উঠে পাশাপাশি শুয়ে সে কী ঘুম! এক কোণে হোটেলওলা কখন ওদের নতুন জামা, সাদা চুল-বাঁধার ফিতে তুলে রেখেছে ওদের চোখও পড়ল না। গাছতলায় গামলা-ভরা ভাজা মাছ, বালতি-ভরা মশলা-মাখা মাংস, থলি-ভরা বাসমতি চাল পড়ে রইল। উনুন জ্বলে জ্বলে নিবে গেল, কেউ দেখবারও রইল না।
০৯.
দুপুরে বেশি ঘুমুলে সোনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, তাই ঘুম ভাঙতেই টিয়াকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বললে, মাকুকে চাই না। বিশ্রী মাকু। বলতে বলতেই থুতনিটা কঁপতে লাগল। টিয়াও চোখ খুলেই বললে, দুষ্টু মাকু! খেলা দেখাবেনা, সাইকেল চালাবেনা, লুচি বেলবেনা, পেরেক ঠুকবে না, দড়ির জট ছাড়াবে না, হারানো জিনিস খুঁজে দেবে না; হোটেলওলা বেচারি সঙের আধখানা লটারির টিকিট হারিয়ে ফেলেছে, তাও খুঁজে দিচ্ছে না! মাকু ভালো না, চাই না ওকে।
দু-জনার দু-চোখ দিয়ে ঝরনার মতো জল পড়ছে, এমন সময় ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ে গাছ-ঘরের দেয়াল ঠেসে কে যেন এক রাশি জিনিস রেখে গেছে। সবার নীচে দেখা যাচ্ছে কাগজের মোড়ক খোলা দুটি ফ্রক, একটি গোলাপি আর একটি বেগনি, তার উপর গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে বিকেলের মিহি রোদ এসে পড়ে মনে হচ্ছে যেন জামার গা থেকে নরম আলো বেরুচ্ছে!
জামার উপর দু-টি সাদা রেশমের চুল-বাঁধা ফিতে; তার পাশে হলুদ কাগজে মোড়া দুটি ছোটো প্যাকেট, তাতে পেনসিল দিয়ে লেখা– ইতি, স্নেহের সং।
প্যাকেট খুলে দেখে ও মা কী সুন্দর ছোটো ছোটো পুঁতিমুক্তো দিয়ে গাঁথা দুটি সাদা মালা!
হলদে প্যাকেটের নীচে আবার দু-টি সবুজ প্যাকেট, তাতে লেখা, জন্মদিনের উপহার, ইতি, হোটেলওলা। ভিতরে সরু লেসের পাড়-দেওয়া ছোটো দু-টি সাদা রেশমি রুমাল। রাগ পড়ে গেল ওদের, কান্না চলে গেল, কিন্তু আনন্দের চোটে চোখ ভরে অন্য রকমের জল এল, তাতে মনে বড়ো আরাম হয়।
ঠিক সেই সময় গাছ বেয়ে জাদুকর উঠে এসে হাসিমুখে বললে, কত বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল দরকার? যেগুলো হাতে আঁটে না, নাকি যেগুলো কোলে ধরে না?
টিয়া তখুনি বলল, আরও বড়ো।
সোনা বলল, আছে তোমার?
জাদুকর একটু হাসল, নাই-বা থাল, দোকানে গিয়ে পয়সা ফেললে থাকতে কতক্ষণ?
টিয়া কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, পয়সা আছে? কই পকেট দেখি!
জাদুকর পকেট উলটে দেখাল তার কাছে একটা কানাকড়িও নেই। ফিকফিক করে হাসতে হাসতে বলতে লাগল, নেই তো হয়েছেটা কী? সাড়ে-তিন গাঁ থেকে প্রত্যেকটা লোক মালিকের জন্মদিনে খেলা দেখবে বলে টিকিট কেটেছে, স্বর্গের সুরুয়া খাইয়ে সবাইকে মালিক যে হাতের মুঠোর মধ্যে রেখেছে। সংদের থলিতে দেড় হাজারের বেশি দশ পয়সা জমা হয়েছে। আরে ছোঃ, আমাদের আবার টাকার ভাবনা!
সোনা বললে, হা, তা ছাড়া জাদুকররা তো লোকদের নাক থেকে কান থেকে টাকা বের করে, মনে আছে টিয়া? জাদুকর একটু বিরক্ত হয়ে গেল, কী বাজে বকছু, জাদুর নিয়ম হচ্ছে জাদুকরের নিজের কাছে যত টাকা আছে, তার বেশি বের করতে পারবে না। শুনে ওরা তো অবাক! একটু গম্ভীর হয়ে সোনা বলল, কিন্তু কী দেখতে আসবে গাঁয়ের লোকেরা?
টিয়া হেসে ফেলল, কেন, কেন আমরা নাচব গাইব, দড়াবাজির খেলা হবে, জাদুকর পরিদের রানিকে নামাবে, না জাদুকর?
জাদুকর খুব খুশি, হা, সেইটাই হল আসল খেলা। কই নামাক তো দেখি পরিদের রানিকে আর কেউ!
সোনার তবু হাঁড়িমুখ, কিন্তু জানোয়াররা তো কড়া জোলাপ খেয়ে শুয়ে পড়েছে আর মাকু তো খেলা দেখাবে না। এই বলে দু-জনে জড়াজড়ি করে এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নায় ফেটে পড়ল। জাদুকর ভারি অপ্রস্তুত। ওমা, ছি, কাঁদে কেন? নিশ্চয় মাকু খেলা দেখাবে, দেখবে কত মজা! আমি একবার মাকুর খেলা দেখেছিলাম, অমনটি আর হয় না। আরে, এরা বেশি কাঁদে যে! ও হরি, তালেগোলে আসল কথাই যে ভুলে যাচ্ছিলাম, যে জন্যে আমার এখানে আসা! তোমাদের জন্য মালিকের জন্মদিনের উপহার এনেছি যে!
এই না বলে শূন্য থেকে খপ খপ করে গোলগাল দু-টি সাদা খরগোশের বাচ্চা ধরে দিল। লাল টুকটুকে তাদের চোখ, গলায় লাল ফিতেয় ছোটো দু-টি ঘন্টি বাঁধা, নড়লে চড়লে টুং টুং করে বাজে। তারা সোনা-টিয়ার কোলে বসেই, গাছঘরের মেঝেতে ছড়ানোনরম ঘাস খেতে আরম্ভ করে দিল। সোনা-টিয়া হেসে লুটোপুটি।
জাদুকর কোট পেন্টেলুন ঝাড়তে ঝাড়তে হঠাৎ বললে, মাকুকে পাওয়া গেছে।
চমকে সোনা-টিয়া আরেকটু হলেই গাছঘর থেকে পড়ে যাচ্ছিল। সোনা-টিয়ার কানে কানে বলল, চুপ, কিছু বলবি না।