তাই শুনে রোগা একটা ন্যাড়া গাছ থেকে কে যেন বললে, ঠিক ঠিক ঠিক। সোনারা চেয়ে দেখে বিরাট একটা টিকটিকির মতো জানোয়ার, গোল চোখ, এবড়োখেবড়ো গা, পিঠে মাছের পাখনার মতো ডানি, গাছের সঙ্গে গায়ের রং মিলিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে, গলার কাছটা ধুকপুক করছে। তার সামনে, বেশ খানিকটা দূরে, খুদে একটা সুন্দর ফিকে বেগনি প্রজাপতি এসে বসল, সঙ্গে সঙ্গে সড়াৎ করে লম্বা জিভ বেরিয়ে প্রজাপতি উদরস্থ!
সোনা-টিয়া চোখ ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল। পথের ধারে প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়িতে মস্ত কালো কোটর, তার মধ্যে উঁকি মারতেই বেজির মতো একটা লম্বা জানোয়ার, লোমওয়ালা মস্ত ল্যাজটা সোজা রেখে সাঁ করে বেরিয়ে গাছগাছালির মধ্যে মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল, সোনা-টিয়া দেখলে কোটরের তলাটা পাখির ডিমের খোলায় ভরতি। টিয়া একটা তুলে নিল। মাথার উপরে তাকিয়ে সোনা দেখে লম্বা একটা খাড়া সুড়ঙ্গের মতো, তাতে থেকে থেকে এক জোড়া করে গোল চোখ গুলগুল করে জ্বলছে। সোনা-টিয়াকে কোটর থেকে টেনে বের করে আনল। টিয়ার হাতের ডিমের খোলাটার কেমন কচি সোনালি রং, তাতে খয়েরি রঙের ফুটকি দেওয়া। সোনা বলল, পুটলিতে তোর রং পানের কৌটোতে রেখে দে, নইলে ভেঙে যাবে।
টিয়া বললে, মোটেই আমার কৌটো নয়, ঠামুর। তাহলে পানগুলো কোথায় রাখি?
সোনা বললে, দে খেয়ে ফেলি দু-জনে, খিদে পেয়েছে। সকালে ডিম রুটি খাইনি।
টিয়া বললে, আম্মা আমার ডিমে নুন গোলমরিচ দিয়ে দেয়নি। বলে আবার খানিকটা কেঁদে নিল। সোনা কোনো কথা না বলে টিয়ার মুখে একটা মিষ্টি পান গুঁজে দিল আর কাদা হল না। দুটো বড়ো পান খেয়ে দু-জনার পেট ভরে গেল, টিয়ার ফ্রকের সামনে খানিকটা লাল ঝোল লেগে গেল, টিয়া সেটাতে হাত দিয়ে ঘষে বললে, কিছুই হবে না, মাকু নতুন জামা কিনে দিয়েছে, আজ মালিকের জন্মদিনে সেটা পরব, না দিদি?
সোনা বললে, কিন্তু মাকুকে না পেলে কী করে সার্কাস পার্টির খেলা হবে? জানোয়াররা যে সবাই জোলাপ খেয়ে শুয়ে পড়েছে।
টিয়া হঠাৎ খুব জোরে হাঁক দিল মা-কু-উ-উ!অমনি দেখে সামনে মাকু! দু-জনাতে ছুটে গিয়ে ওর দু-হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বকতে লাগল, কোথায় গিয়েছিলে মাকু? আজ রাতে যে তোমাকে খেল দেখাতে হবে, জানোয়াররা জোলাপ খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে! শুনে মাকু যেন আকাশ থেকে পড়ল! খেল দেখাতে হবে আবার কী? কীসের খেল?
সোনা রেগে গেল। কীসের খেল আবার মাকু? সার্কাসের খেল, যার জন্য ঘড়িওলা তোমাকে বানিয়েছে, সেই খেল।
মাকু একটা পুরোনো উইটিপির উপর বসে পড়ে বলল, আমাকে ঘড়িওলা বানিয়েছে নাকি? কী দিয়ে বানাল?
সোনা বললে, সব ভুলে যাচ্ছ নাকি, মাকু? তাহলে নিশ্চয় তোমার চাবি ফুরিয়ে এসেছে। তুমিও যদি হাত-পা এলিয়ে পড়ে যাও, তাহলে কী হবে? না, না, মাকু লক্ষ্মী ছেলে, নাচবে, গাইবে, অঙ্ক কষবে, সাইকেল চালাবে, পেরেক ঠুকবে, না মাকু?
মাকু বললে ওসব করতে পারব না।
সোনা বললে, জানো, জাদুকর পরিদের রানিকে ফঁস দিয়ে নামাবে, আমরা তার সাদা পোশাক দেখে এসেছি, তাতে চাঁদ তারা দেওয়া।
মাকু বললে, কিছু করতে পারব না।
টিয়াও রেগে গেল, নিশ্চয় পারবে। তোমার পেটে ঘড়ির কল বসানো আছে-না?
মাকু বললে, না, মোটেই না।
সোনা বোঝাতে লাগল, কেমন কাদার কল বসিয়ে দেব তোমার মাথায়, পরিদের রানির সঙ্গে বিয়ে হবে, না মাকু?
মাকু হঠাৎ পেছন ফিরে চোঁ-চোঁ দৌড় মারল। কত ডাকল সোনা-টিয়া, কত কদল, তবু মাকু ফিরে এল না। তখন চোখ মুছে সোনা বলল, আয়, টিয়া, আমাদের নাচ-গানটা ভালো করে তৈরি করি। মাকু না করল তো বয়ে গেল।
বনের মধ্যে গাছের নীচে দু-জনায় ময়লা জামা পরে নাচতে গাইতে লাগল, গাছ থেকে টুপটাপ সাদা ফুল পড়তে লাগল, সোনা-টিয়া সেগুলোকে চুলের মধ্যে কানের পেছনে গুঁজে রাখল। কোথা থেকে এক জোড়া সবুজ পায়রা উড়ে এসে গাছের ডালে বসে বললে, বাকুম বাকুম! পাতার আড়াল থেকে কাঠঠোকরা ঠুনু ঠুনুন করে তাল দিতে লাগল, ঝোঁপের পাশে বনময়ূর এসে পেখম ধরে নাচ জমাল।
টিয়া গান থামিয়ে বলল, ময়ুর নেচো না, শেষটা যদি বৃষ্টি পড়ে, তা হলে বটতলার উনুন নিববে, ঘাসজমিতে খেলা বন্ধ হবে।
টিয়ার বোকামি দেখে সোনা অবাক। জন্তুরাও যদি খেলা না দেখায়, মাকুও যদি পালিয়ে যায়, তাহলে মালিক বেচারার জন্মদিনের সার্কাস হবে কী করে? তবে মাকুর চাবি ফুরিয়ে গেলেই মাকু এলিয়ে পড়বে, তখন তাকে ঘড়িওলার কাছে দিয়ে দিলেই হবে! ঘড়িওলা ওকে বানিয়েছে, ও তো কলের মানুষ, কলের মানুষরা কথা শোনে।
টিয়া বললে, মোটেই শোনে না; তাই তো মাকু ঘড়িওলাকে খুঁজে বেড়ায়। দিদি, মামণি বাপি কেন আসছে না?
সোনার বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। কাল রাতে ওরা বাড়ি যায়নি, নিজেদের খাবার খায়নি, নিজেদের বিছানায় শোয়নি, কাপড় ছাড়েনি, তবু কেউ খুঁজতে এল না, এটা কী করে হল?
টিয়া বলল, বাড়ি চল দিদি।
সোনা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে, সং বলেছে জাদুকর আমাদের এই বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল দেবে, সে না নিয়ে বাড়ি যাব না।
সং কোথায়?
অমনি মনে পড়ল মাকু পালিয়েছে, এবার তাহলে কী হবে? টিয়া বললে, কেন, আমি আমাদের ক্লাসের গানটাও গাইব, এই বলে গান ধরল–ছোটো শিশু মোরা–