প্যায়দার কথা শুনে সোনা-টিয়ার হাসি পায়, কান্না থেমে যায়। প্যায়দা আসবে কী করে, সে তো এখন বাঘের ফাঁদে পড়ে চেঁল্লাচ্ছে! কিন্তু সে-কথা কাউকে বলা যায় না, যদি কেউ প্যায়দাকে তুলে আনে, প্যায়দা যদি ঘড়িওলাকে ধরে ফেলে, ঘড়িওলা ধরা পড়ে যদি মাকুর কথা প্যায়দাকে বলে। তাই সোনা-টিয়া দু-হাত দিয়ে এ-ওর মুখ চেপে চুপ করে রইল।
জাদুকর প্রথম কথা বলল। ঘড়িওলাকে বলল, কোথায় তোমার মাকু? তাকে পেলে জানোয়ারদের বাদ দিয়েই খেলা দেখানো যায়। নইলে তিন-গাঁ লোক আগাম টিকিট কেটে রেখেছে, এসে, খেলা দেখতে না পেলে, আমাদের মাটিতে বিছিয়ে দেবে যে!
ঘড়িওলা ফোঁত ফোঁত করে কাঁদতে লাগল। হোটেলের মালিক বলল, সে পালিয়ে গেছে! জাদুকর জানতে চাইল, কেন, পালাল কেন?
–ঘড়িওলাকে খুঁজতে গেছে। তার কাঁদার কল চাই।
–তুমিই হলে নষ্টের গোড়া, তোমার পরিদের রানির খেলা দেখে মাকু বলে, আমার সঙ্গে ওর বিয়ে দাও। সবাই বললে, তুমি কলের পুতুল, হাসতে জান না, কঁদতে জান না, তোমার সঙ্গে আবার বিয়ে কী! সেই ইস্তক দিনরাত ঘড়িওলার কানের কাছে ঘ্যানর-ঘ্যান হাসতে একটু একটু পারি, কিন্তু কাদার কলটা দিতেই হবে! এদিকে ঘড়িওলার বিদ্যে ফুরিয়ে গেছে, কাঁদার কল দেয় কী করে? তা মাকু এমনি নাছোড়বান্দা যে শেষপর্যন্ত না পালিয়ে ও বেচারা করে কী? তা ছাড়া ঘড়ির দোকানের মালিক ওর নামে নালিশ করেছে, ধরা পড়লে জেলে পুরবে!
এই বলে হোটেলওলা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
জাদুকর বললে, কী জ্বালা, এই সামান্য কারণে মাকু পালাল? আরে আমাকে বললে তো একদিন কেন, রোজ পরিদের রানির সঙ্গে ওর বিয়ে দিতাম। কলের মানুষের সঙ্গে মহা ধুমধাম করে রোজ পরিদের রানির বিয়ে হত, কাতারে কাতারে লোক দেখতে আসত, ঝমঝম করে টাকার রাশি ঝরে পড়ত, শুধু ঘড়িওলার কেন, আমাদের সার্কাস পার্টিরও সব ধার শোধ হয়ে যেত, তাহলে আমাদের মালিকরা যাক গে, এখন মাকুকে খুঁজে বের করা হোক তাহলে।
ঘড়িওলা বলল, আমার ভয় করে, আবার হেঁকে ধরবে, কাঁদার কল দাও শিগগির!
জাদুকর বললে, কী জ্বালা! বলছি, ওকে কাঁদতে হবে না, এমনি বিয়ে দেব।
টিয়া বলল, তা ছাড়া দিদি ওর কাঁদার কল বানিয়ে দেবে বলেছে।
ঘড়িওলা বিশ্বাস করতে চায় না। সত্যি দেবে সোনা, কী করে দেবে, কীই-বা জান তুমি?
সোনা বুক ফুলিয়ে বলল, কেন, আমি যোগ-বিয়োগ জানি, ছোটো নদী দিনরাত জানি। তা ছাড়া কঁদার কলের জিনিসপত্র সবই আমার সঙ্গে আছে।
অমনি যে-যার উঠে পড়ল, চলো, মাকুকে খুঁজে আনা যাক।
জানোয়াররা জোলাপ খেয়ে শুয়ে থাকুক, মাকু খেলা দেখিয়ে বাজিমাত করে দেবে! হুড়মুড় করে বটতলা থেকে সবাই বেরিয়ে পড়ল, খালি হোটেলওলা এখানে-ওখানে আঁতিপাঁতি লটারির টিকিটের আধখানা খুঁজে বেড়াতে লাগল।
টিয়া তাই দেখে বলল, তুমি কেঁদনা, হোটেলওলা, মাকুকে খুঁজে এনে, আমি তোমার আধখানা টিকিট খুঁজে দেব।
রান্নাবান্নার জোগাড়ও গাছতলায় পড়ে রইল, হোটেলওলাও মাকুর খোঁজে চলল। সোনা-টিয়ার হাত ধরে অন্য পথ ধরল।
০৮.
শেষ অবধি বনের ঝোঁপঝাড়ে খুঁজে খুঁজে মাকুকে পাওয়া গেল না। টিয়ার কান্না এল, দিদি, ষষ্ঠী ঠাকরুন ওকে খেয়ে ফেলেনি তো? সোনা চটে গেল, তোর যা বুদ্ধি, ও কি ক্ষীর, যে খেয়ে ফেলবে, ও তো টিন আর রবার, স্প্রিং আর প্লাস্টিকের তৈরি, ওকে বাঘেও খাবে না।
টিয়া খুশি হয়ে মুখ তুলে হাঁক দেয়, ও–মাক-উ-উ-উ!হাঁকের চোটে পুরোনো বিশাল বনের গাছের গায়ে ঝোলা দাড়ি-গোঁফের মতো আগাছাগুলো দুলতে থাকে। সোনা-টিয়া অবাক হয়ে দেখে।
কোথায় যে গা ঢাকা দিল মাকু তার ঠিক নেই। বনের মধ্যে কত সব লুকোবার জায়গা দেখে সোনা-টিয়া অবাক হয়। নোনো এখানে এলে কী খুশিই যে হত, ল্যাজ নেড়ে খেউ খেউ করে একাকার করত। এক জায়গায় গোল হয়ে ঝোঁপ গজিয়েছে, তাতে কী সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে, সুগন্ধে চারিদিক ভুরভুর করছে, গাছের সারা গায়ে বেঁটে বেঁটে কাটা। তবু তারই মধ্যে কোনোমতে ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকে, সোনা-টিয়া অবাক হয়ে দেখে, মাঝখানটা একেবারে ফঁকা, কচি নরম দুর্বোঘাসে ঢাকা, তারই মধ্যে লাল লাল চোখ, সাদা ধবধবে মা-খরগোশ, দুটো সাদা তুলোর গোছর মতো বাচ্চা নিয়ে ওদের দিকে চেয়ে চেয়ে থরথর করে কাঁপছে। আম্মা একবার বলেছিল, ওর একটা উড়নচড়ে ছেলে আছে, তার নাম রঙা, সে নাকি খরগোশ ধরে বাজারে বিক্রি করে অনেক পয়সা রোজগার করে। খরগোশেরা নাকি খুব বোকা, তাই সহজেই ধরা পড়ে। খরগোশ খেতে নাকি খুব ভালো, তাই লোকেরা কেনে। সোনার গলায় একটু ব্যথা করে।
টিয়া বললে, দিদি, ওদের কী নাম দিবি? সোনা ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে টিয়াকে চুপ করতে বলল, তারপর জোরে ঠেলে দিয়ে ঝোঁপ থেকে বের করে আনল, কাঁটা লেগে সোনার হাতের এতখানি ছড়ে গেল, সোনা রক্তটা চুষে ফেলে বলল, বড্ড ভয় পেয়েছে। ভেবেছে ওকে মারব, ওর বাচ্চাদের নিয়ে নেব।
সোনার নীচের ঠোঁটটা একটু কাপল, টিয়া তাই-না দেখেই অমনি ভা–আঁ! সোনা ওর দিকে একবার দেখে নিয়ে জোরে ডাকল, মাকু-উ-উ-উ, মা–আ-আকু, আর কোনো ভয় নেই রে-এ-এ।
টিয়াও চাঁচাতে লাগল– ও মাকু আয় রে–এ-এ! কেউ কিছু বলবে না–আআ।