টিয়ার বুদ্ধি দেখে সোনার রাগ ধরে। ঘড়িওলা কোত্থেকে দেবে, টিয়া? শুনলেনা মাকুকে তৈরি করতেই ওর সব বিদ্যে ফুরিয়ে গেছে? তুমি কী বোকা!
তাই শুনে কাঁদবার জন্য হাঁ করেই টিয়া আবার মুখ বন্ধ করে বলল, তুই কী দিয়ে তৈরি করবি? বোকা বোকা বোকা!
টিয়ার পিঠে গুম করে একটা কিল বসিয়ে, সোনা বলল, আমার কাছে জিনিসপত্র আছে, আমি বানিয়ে দেব। চল। কাঁদতে ভুলে গিয়ে টিয়া আবার দৌড়োত শুরু করে। এমনি সময় সামনে দিয়ে একেবারে ওদের নাক ঘেঁষে প্রকাণ্ড বড়ো রঙিন প্রজাপতি উড়ে যায়। এত বড়ো প্রজাপতি ওরা কখনো দেখেনি। সোনার দুটো হাতের তেলো পাশাপাশি জুড়লে যত বড়ো হয়, তার চেয়েও বড়ো। আর কী রঙের বাহার, গায়ে নীল, সবুজ, সাদা, কালো বর্ডার দেওয়া, লাল সুতো-আঁকা রামধনু রঙের চোখ বসানো।
আর কথা নেই, হাঁ করে পথ ছেড়ে ওরা প্রজাপতির সঙ্গে সঙ্গে দৌড়োতে থাকে। প্রজাপতি গাছের গোড়ায় ভূঁইচাপা ফুলের মধু খায়, ওরা হাঁ করে চেয়ে দেখে; কাছে গেলেই উড়ে পালায়।
প্রজাপতি মগডালে বুনো বাতাবি লেবুর ফুলে বসে, ওরা ডাল ধরে নাড়া দিলেই উড়ে পালায়। গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে এই রোদে এই ছায়ায় প্রজাপতি, নীচে নেমে ঘাস ফুলের পাতায় বসে ঘাসের বোঁটা নুইয়ে পড়ে মাটি ছোঁয়। ঘাসের ওপর ওদের ছায়া দেখলেই প্রজাপতি উড়ে পালায়। কখনো উঁচুতে কখনো নীচে ওড়ে, রোদে বসে ডানা কঁপায়, ওদের সাড়া পেলেই উড়ে পালায়।
দৌড়ে দৌড়ে দৌড়ে সোনা-টিয়া আর পারে না, পা ব্যথা করে। এমনি সময় দুটো বেঁটে করমচা গাছের ডালের মধ্যে ঝোলানো বড়ো মাকড়সার মোটা জালে প্রজাপতির পা জড়িয়ে যায়, সোনা-টিয়ার প্রায় হাতের মুঠোর মধ্যে!
করমচার ডালের আড়ালে বসে মাকড়সা সব দেখেছে, যেই-না সুতো বেয়ে প্রজাপতি ধরবে, সোনা হাত বাড়িয়ে জাল ছিঁড়ে দেয়, প্রজাপতি আবার উড়ে পালায়।
টিয়া বললে, দিদি, ধরলি না যে? সোনা বললে, আম্মা বলেছে প্রজাপতিদের ডানার রঙের গুড়ো হাতে লেগে গেলে আর প্রজাপতিরা উড়তে পারে না, মাটিতে পড়ে যায়।
–তারপর কী হয়?
কাগরা ওদের ঠোকরায়, মাকড়সারা চুষে খেয়ে ফেলে, প্রজাপতিরা মরে যায়!
টিয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে বলে, না, মরে যায় না। তুই ওদের জাল থেকে খুলে দিস, ওরা উড়ে বাড়ি চলে যায়, ওদের মার কাছে! আমি মামণির কাছে যাব।
সোনা ঢোক গিলে টিয়ার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বললে, কাদছিস্ যে, মাকুকে খুঁজে বের করতে হবে না?–ও কীসের শব্দ?
বলতে বলতে কখন ওরা আবার বাঘের ফাঁদের কাছে এসে পড়েছে, ঝোপেঝাড়ে আগাছায় আড়াল করা গর্তের মুখ, তারি ভিতর থেকে সে কী চাচামেচি। সোনা ফিসফিস করে বলল, দুষ্টু লোকটা মরে যায়নি, ওই শোন চাঁচামেচি করছে!
আর সেখানে নয়, একদৌড়ে সোনা-টিয়া আবার বটতলার হোটেলে এসে হাজির!
হোটেলে মহা ভিড়, সবাই ব্যস্ত। সর্বনাশ হয়ে গেছে। সং জানোয়ারদের ভিটামিনের বদলে ভুল করে কড়া জোলাপ খাইয়ে দিয়েছে। এখন আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা বাদে, হোটেলওলার জন্মদিনের পার্টি। মহড়াই-বা হবে কখন, সাজবেই-বা কখন, খেলা দেখাবেই-বা কী করে? জানোয়াররা কাত হয়ে পড়েছে, সং মনের দুঃখে বুক চাপড়াচ্ছে। সব বুঝি পণ্ড হয়।
টিয়া বলল, পণ্ড হবে কেন? আমরা যে নাচব, গাইব। দড়াবাজির লোকেরা দড়িতে চড়বে। জাদুকর পরিদের রানিকে নামাবে–কিন্তু জোড়া ঘোড়া কোথায় পাবে?–ও সং, ঘোড়াদের কেন জোলাপ খাওয়াতে গেলে?
ভাবনার চোটে কালো চাদর খুলে ফেলে দিয়ে ঘড়িওলা সকলের সামনে বেরিয়ে পড়েছে। সে বললে, আ সর্বনাশ! এমন দিনে এমন কাজ করতে আছে? তাও যদি আমার মাকু কাছে থাকত গো; সে একাই বাজিমাত করে দিত। আহা, ফাস্ট ক্লাসের বাবুরা তার কী প্রশংসাই না করেছিল, তাও তো সব দেখেনি। মাকু আমার কলের মানুষ হলে কী হবে, ওর ক্ল্যারিওনেট বাজানো যে একবার শুনেছে, সে কি আর ভুলতে পেরেছে–কোথায় রোজ খেলা দেখিয়ে আমাকে বড়োলোক করে দেবে, তা নয়, পরিদের রানিকে বে করার বায়না!
এই অবধি শুনেই টিয়া মহা রেগে গেল, তবে যে বলেছিল মাকুর কলকজা খুলে থলেয় পুরবে, যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেবে, তাই তো আমরা মাকুকে—
সোনা-টিয়ার গালে ঠাস করে এক চড় লাগাল, টিয়া কথা ছেড়ে ভা, আর ঘড়িওলা ভয়ে কুঁচকে এতটুকু হয়ে গেল। তার পেছনে যে হুলিয়া লেগেছে, দুঃখের চোটে সে-কথা ভুলে, সবার সামনে মাকুর কথা বলে ফেলে এখন নিজের মাথায় কী সর্বনাশ ডেকে আনল কে জানে!
কিছুক্ষণ সবাই গুম হয়ে রইল। ঘড়িওলা ভয়ে দুঃখে চিৎকার করে বলল, দাও-না এবার সবাই মিলে ঠ্যাং ধরে টেনে আমাকে গারদে ঠুসে! হ্যাঁ, আমি ঘড়ির দোকানের গুদাম থেকে কলকজা চুরি করে, সতেরো বছর খেটে মাকুকে বানিয়েছি। তাই আমার পেছনে পেয়াদা লেগেছে। এক মাস যদিমাকুর খেলা দেখাতে পারতাম, সব ধার শুধে, কলকজার দাম চুকিয়ে কেঁচড়-ভরা টাকা নিয়ে, মার কাছে ফিরে যেতে পারতাম। ওমা, মা রে, কোথায় গেলি রে, কদ্দিন মোচার ঘণ্ট খাইনি।
ঘড়িওলা ডুকরে কাঁদতে থাকে, সোনা-টিয়াও সঙ্গ ধরে, হোটেলের মালিক ঘড়িওলার বড়ো ভাই, তারও মায়ের জন্য মন কেমন করে, সে গলা খাঁকরে, নাক টেনে, ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, এই, বড্ড গোলমাল হচ্ছে, কে কোথায় শুনতে পাবে, প্যায়দা এসে বনে সেঁধিয়েছে, সে কথা ভুললে চলবে কেন?