কী ভালো দেখাচ্ছে জানোয়ারদের! সবাই আজ স্নান করেছে, গায়ে মাথায় বুরুশ ঘষেছে। গলার কলার ঘণ্টি আজ সব পরিষ্কার ঝকঝক করছে। সার্কাসের লোকদের পোশাকও রোদে দেওয়া হয়েছে। দড়িতে যে কালো মেম ছাতা নিয়ে নাচে, সে একটা বড় উঁচ আর সুতো নিয়ে ছেঁড়া জায়গা জোড়া দিচ্ছে। নতুন কাপড়-জামা ওরা কোথায় পাবে?
মেম একগাল হেসে পরিষ্কার বাংলায় সোনা-টিয়াকে বলল, আমি আজ সোনালি ঘুন্টি দেওয়া লাল গাউন পরব। তাতে নতুন করে জরির ফিতে লাগিয়েছি। তোমরা বার্থডে পার্টিতে কী পরে যাবে?
সোনা-টিয়া তো হাঁ! তাই তো, কী হবে তা হলে? ওদের সঙ্গে যে ওই একটা বই দুটো ফ্রক নেই! কাল থেকে পরে আছে, কুঁকড়ে-মুকড়ে একশা হয়ে গেছে। দু-জনে নিজেদের জামার দিকে তাকিয়ে ঊ্যা করে কেঁদে ফেলল। সং ছুটে এল, কী মেম, ওদের কাঁদাচ্ছ কেন? কাদার কী আছে গা? হোটেলের চাকর বেহারি যে তোমাদের জন্যে জামা কিনবার পয়সা দিয়েছিল, তাও জান না? এই দেখো, কী সুন্দর জামা এনেছি, এই পরে তোমরা পার্টিতে যাবে!
কোত্থেকে দুটো কাগজের বাক্স এনে সং ওদের হাতে গুঁজে দেয়।
টিয়া অবাক হয়ে বলে, বেহারি? এখানে বেহারি এসেছে নাকি? তাহলে মামণিও—
সোনা তাকে এক ঝকি দিয়ে কানে কানে বলে, চুপ, বোকা, বেহারি হল মাকু, মনে নেই? এখানে ওর নাম করিস না কখনো!
টিয়া যা কাঁদুনে, হয়তো আরেকবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে নিত, যদি-না সং তাড়াতাড়ি বাক্স খুলে জামা দুটো দেখাত। কী সুন্দর জামা সে বলা যায় না। একটা গোলাপি, একটা ফিকে বেগনি!তলায় কুঁচি দেওয়া, গলায় ছোট্ট একটা করে রুপোলি ফুলের মতো বোতাম। দেখেই সোনা-টিয়া হেসে ফেলল। মেম উঠে এল, দু-জনের হাতে দু-টুকরো রেশমি ফিতে দিয়ে বলল, এই নাও, হোটেলওলার জন্মদিনে তোমাদের প্রেজেন্ট। ও বেলা চুলে বো বেঁধে। সং ওদের জুতো পালিশ করিয়ে দাও।
ওমা, যে লোকটা ঘোড়ার খুরে পালিশ লাগাচ্ছিল, সে-ইতাড়াতাড়ি এসে ওদের জুতোতেও ওই পালিশ লাগিয়ে, ন্যাকড়া ঘষে আয়নার মতো চকচকে করে দিল।
হাসিমুখে সোনা জিজ্ঞাসা করল, বেহারি কোথায়?
অমনি সবাই একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সং ছাড়া ওকে এরা কেউ বোধ হয় তেমন পছন্দ করে না।
দড়াবাজির ছেলেরা বলল, চাকরের আবার অত দেমাক বুঝি না! গটগট করে চলে ফেরে, কটমট করে তাকায়, ঠোঁট ফাঁক করে সহজে দুটো কথা বলে না। কেন? আমরা কি ফেলনা নাকি। হোটেলের চাকর কীসে আমাদের চেয়ে ভালো হল শুনি? মোট কথা, সে অনেকক্ষণ আগে এখান থেকে চলে গেছে, আর না ফিরলে বাঁচি!
তাই শুনে টিয়া রেগেমেগে আর একটু হলেই সব কথা ফাঁস করে দিয়েছিল আর কী, ভাগ্যিস সোনা বুদ্ধি করে ঠিক সেই সময়ে জিজ্ঞেস করল, আজ বিকেলে কী কী খেলা হবে বলোনা।
–হ্যাঁ? প্রথমেই হবে দড়াবাজি।
দড়াবাজির ছোকরারা বলল, গোড়াতেই জমিয়ে দিতে হবে কিনা, নইলে লোকে শেষ অবধি বসে থাকবে কেন বলো? দড়াবাজির মতো খেলা হয় না, একথা কে না জানে-। সং বাধা দিয়ে বলল, তারপর কুকুরদের খেলা, তারপর জাদুকরের।
টিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, জাদুকর পরিদের রানিকে নামাবে?
–ওমা– তা নামাবে না? নইলে আবার খেলা কীরকম হল? ওই দ্যাখো, রানির পোশাক রোদে শুকুচ্ছে!
বাস্তবিকই তাই। ঘাসের ওপর এতখানি জায়গা জুড়ে পরিদের রানির সাদা ধবধবে পোশাক পাতা রয়েছে, তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো রুপোলি বুটি ভোলা, পাশেই রুপোলি ডানা-জোড়াও শুকুচ্ছে। তার পাশে কাগজের বাক্স খোলা পড়ে আছে, তার মধ্যে পরিদের রানির মাথার তারা-দেওয়া মুকুট, হাতের চাঁদ-বসানো রাজদণ্ড, গলার সীতাহার, হাতের তাগা, কানের ঝুমকো। দেখে দেখে সোনা-টিয়া আর চোখ ফেরাতে পারেনা। গয়নার সঙ্গে রুপোলি পাড়-দেওয়া সাদা রেশমি রুমালও রোদে শুকুচ্ছে।
–কিন্তু রানি কই? প্রশ্ন শুনে দড়াবাজির ছোকরাদের খুক খুক করে সে কী হাসি!
সোনা-টিয়ার চকচকে চোখ দেখে মেম বলে, কী বেবিরা, তোমরাও আজ রাতে নতুন জামা গায়ে দিয়ে একটু নাচো-গাও না কেন? কী বল লোজনরা?
তাই শুনে লোকজনদেরও মহা উৎসাহ, হা, হ্যাঁ, সোনা-টিয়াও নাচবে গাইবে। কী, তোমরা নাচতে গাইতে জান?
সোনা-টিয়া খিলখিল করে হেসে ফেলল। নাচতে-গাইতে জানে না আবার কী? এই-না সেদিন স্কুলের দুই ক্লাসের সব মেয়ে মিলে ফুলের মালা গলায় দিয়ে হাত ধরাধরি করে করে, ফুলকলি, আসে অলি গুগুন্ গুঞ্জনে–নাচল গাইল, গার্জেনরা কত হাতহালি দিল!
তক্ষুনি সোনা-টিয়া হাত ধরাধরি করে একটুখানি নেচে গেয়ে দেখিয়ে দিল।
সবাই মহা খুশি!
ঠিক এমনি সময়ে, হন্তদন্ত হয়ে, ঘোড়ার খেলা দেখায় যারা তারা ছুটে এল। সংকে বলল এক্ষুনি এসো–ভীষণ ব্যাপার!
ভীষণ ব্যাপারশুনেই আবার সোনা-টিয়ার মাকুর কথা মনে পড়ে গেল। ওরা এখানে দিব্যি নাচ-গান করছে, আর ওদিকে মাকু যদি বটতলার সরাইখানায় গিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে হয়তো স্কুড্রাইভার দিয়ে ঘড়িওলা–; আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, টিয়ার হাত ধরে, বটতলার দিকে সোনা দৌড় দিল।
মেম ডেকে বলল, ওমা! নতুন জামা নেবেনা?
ফিরে এসে, জামা ফিতে নিয়ে আবার ছুটল ওরা।
০৭.
দৌড়োয় আর হাঁপায় টিয়া, সোনা হাঁপায় না। টিয়া বলে, তুই মাকুকে কাঁদার কল দিবি, না দিদি? তাহলে মাকু আর পালাবে না। কোথায় পাবি কাঁদার কল? ঘড়িওলা বানিয়ে দেবে?