তাই যেখানে যেখানে ফাঁদ পাতা, সেখানে হোটেলওলা একটা করে বাঁশের খুঁটি পুঁতে রেখেছে, লোকে যাতে দেখতে পেয়ে সাবধান হয়। সার্কাসের জানোয়ারদের জন্যই বেশি ভয়।
সোনা একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে, বড়ো ফাঁদের কিনারা থেকে বাঁশের খুঁটি উপড়ে ফেলে দিল। এর মধ্যে মাকুকে ফেলতে হবে; তা হলে আর কেউ তাকে খুঁজে পাবে না, যতক্ষণ-না সোনা-টিয়া দেখিয়ে দেয়। আর ভয় নেই।
টিয়া বলে, দিদি, যদি ওর মধ্যে সাপ থাকে, কাঁকড়াবিছে থাকে, মাকুকে যদি কামড়ায়?
চুপ, টিয়া, চুপ, কথায় কথায় অত কান্না আবার কী! মাকু তো কলের পুতুল, সাপ বিছে ওর কী করবে?
তবু টিয়ার কান্না পায়। সে কেঁদে বললে, আমি কলের পুতুলকে ভালোবাসি, প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কোথায়, মামণি বাপি কোথায়?
তাই শুনে সোনাই-বা করে কী, দু-জনে মহা কান্না জুড়ে দিল। কখন যে বড়ো চিঠি হাতে করে পেয়াদা এসে হাজির হয়েছে ওরা টেরই পায়নি। পেয়াদা হাঁক দিল, ও খুকিরা, এ-বনে যারা থাকে তারা কোথায় গেল বলতে পার? সেই ইস্তক খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি, অথচ কারো টিকির দেখা পাই নে। এ চিঠি যথাস্থানে না পৌঁছেলে আমার চাকরি থাকবে না। বলি, কথা শুনতে পাচ্ছ?
পেয়াদা এসেছে ঘড়িওলাকে ধরতে, মাকুকে ধরতে, সার্কাসের লোকদের ধরতে, আর কি সোনা-টিয়া সেখানে থাকে! দৌড়, দৌড়! পেয়াদাও সমানে চাঁচাতে লাগল, শোনো, শোনো, বটতলায় কারা খাওয়া-দাওয়া করে? ও খুকিরা, কথার উত্তর দাও-না কেন? দাঁড়াও, তোমাদের ধরছি!
এই বলে যেই-না পেয়াদা ওদের পেছনে দৌড়েছে, সে কী মড়মড় হুড়মুড়! পেয়াদা পড়েছে ফঁদে!
০৬-১১. সোনা আর সেখানে দাঁড়াল না
সোনা আর সেখানে দাঁড়াল না, টিয়ার হাত ধরে ঘাসজমির দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। টিয়াকে নিয়েই মুশকিল। ও খালি দাঁড়াতে চায়, খালি বলে, ওর পায়ের ছাল উঠে যায়নি তো? আইডিন দিতে হবে না? ও-কথা ভাবলে সোনারও কান্না পায়, তাই আর থামা নয়, পথ ছেড়ে বনের মধ্যে দিয়ে দৌড়োতে থাকে। থেকে থেকে মুখের সামনে দুই হাত তুলে চোঙা বানিয়ে ডাকে– মাকু-উ-উ-উ! টিয়াও ডাকে মাকু-রে-এ-এ-এ! কেউ সাড়া দেয় না, বনটা যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে।
দৌড়োত দৌড়োতে হাঁপ ধরে, জল তেষ্টা পায়, থামতে হয়। অমনি কানে ঝিম ঝিম শব্দ হয়। গাছের পাতার মধ্যে বাতাস শোঁ শোঁ করে। যেন হিক্কা তুলছে। টিয়ার হাত ধরে গাছতলা থেকে পায়ে-চলা পথে টেনে এনে, সোনা বলে, তক্ষক সাপ, ভারি বিষাক্ত! বলেই টিয়ার মুখ চেপে ধরে, তাই আর তার কান্না জোড়া হয় না। সোনা তার কানের কাছে বলে, দ্যাখ, দ্যাখ! টিয়া, ওই দ্যাখ! টিয়া অবাক হয়ে দেখে, মস্ত একটা ছুঁচোর মতো জানোয়ার আরও বড়ো একটি ব্যাঙের ঠ্যাং ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। ব্যাংটা মাটির ওপরে হিঁচড়ে চলেছে, কীরকম একটি চিচি শব্দ করছে। পথের ধার থেকে একটি ছোটো শুকনো ডাল তুলে সোনা কিছু বলবার আগেই দিয়েছে টিয়া ছুঁচোর মাথায় এক বাড়ি! ব্যাং ছেড়ে পত্রপাঠ ছুঁচোর পলায়ন।
ব্যাংটা ভারি অবাক হয়ে গেছে বোঝা গেল। একটুক্ষণ চোখ পিটপিট করতে করতে কামড়ানো ঠ্যাংটা নিজের মুখে পুরে চুষে নিল। তারপর তিড়িং করে চার লাফে অদৃশ্য। সোনা-টিয়াও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
ওই যাঃ, মাকুর কথা যে আর একটু হলেই ওরা ভুলে যাচ্ছিল। ঘড়িওলা কী নিষ্ঠুর! মাকুকে ক্রুড্রাইভার দিয়ে খুলে খুলে থলেয় পুরে দোকানদারকে ফিরিয়ে দেবে! কক্ষনো না! মুখ তুলে সোনা-টিয়া আবার ডাক দেয় মাকু- উ-উ-উ-উ! গাছের উপর থেকে কানে আসে– ক্ক-র-র-র-র–ক্কু-র-র-র-র। চোখ তুলে চেয়ে দেখে, ওপরের ডালে বসে মা-দাঁড়কাক নীচের ডালে বসা ছানা-দাঁড়কাককে পোকা খাওয়াচ্ছে। দু-জনেই প্রায় সমান বড়ো। কিন্তু মা-দাঁড়কাকের মুখের ভিতরটা কালো কুটকুটে, আর ছানা-দাঁড়কাকের মুখের ভিতরটা লাল টুকটুকে।
তাই দেখে টিয়া থমকে দাঁড়ায়, সোনা তাড়া দেয়, ওরে চল চল, শেষটা মাকুকে ধরে যদি টুকরো করে তাহলে পরে? আবার দৌড় দৌড়! টিয়া আবার বলে, দুষ্টু লোকদের ব্যথা লাগলেও কিছু হয় না, না দিদি?
সোনা ঢোক গিলে বলে, ব্যথা লাগলে চলতেও পারবে না, মাকুকে ধরতেও পারবে না।
টিয়া চোখ মুছে আবার দৌড়োয়, সোনাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দুষ্টু লোকদের জন্য বড্ড কষ্ট লাগে। ছুটতে ছুটতে ওরা ঘাসজমিতে পৌঁছে যায়, তবু মাকুর দেখা মেলে না।
ঘাসজমিতে মহা হইচই, হোটেলওলার জন্মদিনের উৎসবের মহড়া চলেছে। ওরা দেখল সংকে খুব খাটানো হচ্ছে; একটা লোক জানোয়ারদের পা ধুয়ে পালিশ লাগাচ্ছে। আর সং আঁতিপাঁতি ওষুধের শিশি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
টিয়া বললে, কীসের ওষুধ? ওদের কি অসুখ করেছে? দড়াবাজির লোকেরা মহা চটে গেল, রাতে খেলা দেখানো হবে, এখন ওসব অলুক্ষুনে কথা মুখে আনা কেন? অসুখ করবে কেন? ওদের ভিটামিনের বড়ি খাওয়াতে হবে-না? না তো কি অমনি অমনি খেলা দেখাবে? খেলা দেখানো অত সোজা নয় বুঝলে?
ধমক খেয়ে সোনা-টিয়ার কান্না পেল, ওদের চোখের জল দেখে, সংই কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর যেই-না রুমাল দিয়ে চোখের জল মোছাবে বলে নিজের ঢলকো ইজেরের পকেটে হাত দিয়েছে, অমনি পকেট থেকে ছোটো সবুজ কৌটো বেরিয়ে এসেছে। সঙের আনন্দ দেখে কে, পেয়েছি, পেয়েছি! একগাল হেসে টপাটপ করে এক টুকরো করে গুড়ের সঙ্গে জানোয়ারদের গালে একটি করে বড়ি ফেলে দেয়, তারাও সেই খেয়ে মাথা দুলিয়ে ল্যাজ নেড়ে আহ্লাদে আটখানা। মনে হল খুব মিষ্টি খেতে।